ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু
১৫ আগস্ট ২০২১ ১৬:০২
ঢাকা: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্নভাবে প্রাসঙ্গিক। শিক্ষায়, আন্দোলনে, সংগঠনে— সবকিছুতেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগ ছিল। তবে সর্বশেষটা ছিল বেদনার রঙে মাখা, দুঃখের স্মৃতিতে গড়া। ঘাতকের হাতে যে রাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন—সেই রাত পেরিয়ে সূর্যের আলো ফোটা বাকি; পরের দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর আসার কথা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেদিন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে ‘আজীবন সদস্য’ করতে প্রস্তুত হচ্ছিল।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের আগমন উপলক্ষে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় সেজেছিল ভিন্ন এক আঙ্গিকে। ব্যানার, ফেস্টুন, দেয়াল লিখনে ছেয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পাসের আনাচ-কানাচ। কলাভবনের মূল সিঁড়ির দুই পাশে করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরালচিত্র। টিএসসির ভেতরের মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধুর যেখানে বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল সেই মঞ্চে প্রায় ১৬টি মাইক্রোফোন লাগানো হয়েছিল। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন আর বঙ্গবন্ধু কথা বলতে পারেননি। এর আগেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় ঘাতকের গুলিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বাঙালি জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান।
ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মোগলটুলীতে বসবাস ছিল তার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সংযুক্ত ছাত্র ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমি ঢাকায় এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আইন পড়ব। বই পুস্তক কিছু কিনলাম।’
এই বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। বঙ্গবন্ধুর কেবল শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের জন্যও ছিলেন সমানে সমান। ১৯৪৮ সালের মার্চে ন্যায্য দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের করা আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল অনন্য। কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বাড়ানর দাবিতে ধর্মঘট ডাকলে সংহতি জানিয়ে ছাত্রলীগ তাদের পাশে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু তখন ছাত্রলীগের প্রাণভোমরা। এই ঘটনায় ২৭ জন ছাত্রনেতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ক্ষোভের শিকার হন। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন ওই ২৭ জনের একজন। বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, তাদের প্রত্যেককেই দিতে হবে ১৫ টাকা করে জরিমানা। ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে জরিমানা দেওয়ার লোক বঙ্গবন্ধু নন। কর্তপক্ষের চাওয়া অনুযায়ী, ক্ষমা চাইলে শাস্তি মওকুফ হতো; বঙ্গবন্ধু সেটাও চাননি।
সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। সবাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন ভিসির বাসভবনে। আন্দোলন চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। তবে পুলিশ ডেকে আন্দোলনরত সবাইকে গ্রেফতার করিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান উপাচার্য ড. মোয়াজ্জেম। এবার বন্ডে সই করে কারামুক্তির সুযোগ আসে। শাস্তিপ্রাপ্ত সকলেই একে একে বন্ডে সই করে কারামুক্ত হয়েছিলেন। একমাত্র মানুষ, যিনি এই সুযোগটুকুও গ্রাহ্য করেননি, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফলস্বরূপ ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বহিষ্কার করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পরও এই বহিষ্কারাদেশ বহাল ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতির উপর জারি করা এই বহিষ্কারাদেশ বাতিল করতে দেশ স্বাধীনের পরও সময় নেওয়া হয় চার দশক। শেষমেশ ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হিসাবে গণ্য করে ওই বছর ১৪ আগস্টের সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এবার ঠিক উল্টোপিঠের ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০ জুলাই, ১৯৭২। যে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বহিষ্কার করেছিল, সে বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি ফিরে এলেন। এবার ছাত্র হয়ে নয়, আচার্য হয়ে। সেদিন কিছু শিক্ষার্থী বিনা পরীক্ষায় অটোপাসের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ কিছু শিক্ষককে অবরোধ করে রাখে। বঙ্গবন্ধুর কাছে এই সংবাদ পৌঁছালে তিনি নিজেই ছুটে আসেন ক্যাম্পাসে। না, অধ্যাপক মোজাফফরের মতো বঙ্গবন্ধু পুলিশ ডেকে এনে ছাত্রদের গ্রেফতার করাননি। তিনি এলেন, শিক্ষার্থীদের বোঝালেন। কেন তারা অটোপ্রমোশন চাওয়ার মতো অন্যায় দাবি তুলেছেন— তা নিয়ে ভর্ৎসনা করেন তিনি।
বহিষ্কৃত শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক তিনটি মুহূর্ত—১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন— সবকটির জন্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই রেসকোর্স ময়দানে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন। হয়েছে অসংখ্য গবেষণাও। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ এর অধীনে ১৮তম সংবিধি সংযোজনের মধ্য দিয়ে ঢাবিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি’ নামে স্বতন্ত্র একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রস্তাব উপস্থাপন করেন সিনেট সদস্য মনজুরুল আহসান বুলবুল।
বঙ্গবন্ধুর জীবন, দর্শন ও তার অনন্য অবদান এবং নেতৃত্বের উপর উচ্চতর গবেষণা ও চর্চা, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, প্রত্নতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ভূগোল, সঙ্গীত, শিল্পকলা, আইন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা পরিচালনার পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের জন্য অ্যাকাডেমিক মিউজিয়াম, সংগ্রহশালা, পরীক্ষাগার, কর্মশিবির স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসংখ্য ভাবনা ছিল। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ১১ নম্বর আদেশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। কেবল বঙ্গবন্ধুই নন; শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার পরিবারের আরও অনেকেই। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। পুত্রবধূ সুলতানা কামালও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর বহু স্মৃতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে এসে পা রাখবার প্রতীক্ষা এক মুহূর্তের ব্যবধানে অসীম হয়েছিল সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সেদিন দিনের বেলায় সমগ্র ঢাকা শহর ছিল গুমোট। শহরের বুকে এমন এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড যে ঘটে গেল— সেদিন সকালবেলায়ও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি ঢাকাবাসী। এই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে চলেছে প্রতিবাদী সংকলন বের করার তোড়জোড়। গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল আজিজের ১০২ নম্বর কক্ষে করা পরিকল্পনা অনুযায়ী ছড়া আর কবিতায় সাজানো সংকলনটির নাম ছিল ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। এই সংকলনটির এককভাবে কোনো সম্পাদক ছিল না। এটি ছিল যৌথ একটি উদ্যোগ। তবে পুরো কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গণিত বিভাগের সেই আবদুল আজিজ। সংকলনটি প্রকাশের পরিকল্পনা, লেখা সংগ্রহ, ছাপাখানা নির্ধারণ, মুদ্রণব্যয় জোগাড়, প্রচ্ছদ নির্মাণ, বাঁধাই ও বিতরণের ক্ষেত্রে সামনে থেকে কাজ করেছিলেন আবদুল আজিজ। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন বাংলার রাখাল রাজা।
সারাবাংলা/পিটিএম