বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চার নীতিতে দেশ গড়ার আহ্বান
১৬ আগস্ট ২০২১ ২০:০৩
‘বঙ্গবন্ধু সবসময়ই আমদের অন্তরের অন্তঃস্থলে ছিলেন। যখন ছোট ছিলাম, সেই ছাত্রজীবনে পল্টন ময়দানে কাঠের স্টেডিয়াম ছিল সেখানে ফুটবলসহ অন্যান্য খেলাধুলা হতো। সেখানেই বঙ্গবন্ধুসহ অন্যরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেন, ভাষণ দিতেন। সেসময় বাবার হাত ধরে মাঠে খেলা দেখতে যেতাম। তখন বাবাই প্রথম বলেন, ওই যে জোরে জোরে কথা বলছেন, ভালো ভালো কথা বলছেন— ওনার নাম শেখ মুজিব। তখন তাকে আমরা সবাই শেখ মুজিব নামেই চিনতাম। ছোট মানুষ, রাজনীতি অতো বুঝতাম না। কিন্তু বাবা বুঝতেন। তিনি আমাদের নিয়ে যেতেন সেসব কথা শুনতে। বাদাম কিনে দিতেন আর আমরা বসে বসে খেতাম আর শুনতাম। শুনতে ভালোই লাগত। এভাবেই আস্তে আস্তে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ জন্মে। পরে ৬৬ সালে কলেজে যখন উঠেছি তখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেন। সেই ছয় দফা দেওয়ার পর আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যারা ছাত্রলীগ করে বা ছাত্র ইউনিয়ন করে সবারই মনের কথা সেখানে প্রকাশ পায়। আমরা অনুধাবন করলাম পাকিস্তানিরা কীভাবে আমাদের টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। সেসময় পাটের রমরমা বাজার। দেশের প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে পাটের কারখানা। বঙ্গবন্ধুই বললেন, পশ্চিমা পাকিস্তানিরা আমাদের পাটের টাকা নিয়ে যাচ্ছে আর আমরা এখানে না খেয়ে মরছি। সেসব ছিল আমাদের অন্তরের কথা। আর বাঙালির প্রাণের কথা উচ্চারণ করেই তিনি শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন। তখন পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারও বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেতে শুরু করে। এরপর তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আটকানোর চেষ্টা করে। আমরা ভাবলাম এবার বুঝি আইয়ূব খান সরকার আর বঙ্গবন্ধুকে বাঁচতে দেবে না। আমরা কঠোর আন্দোলন গড়ে তুললাম। তখন বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নিলেন না। ফলে তা আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিল। সেই আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সেসময় আমরা প্রেসক্লাবের সামনে দৈনিক পাকিস্তানে আগুন লাগিয়ে দেই। এভাবে তীব্র প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দিতে থাকি আমরা। একসময় আইয়ূব খান সরকার বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মধ্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, যা আমাদের আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়। আমরা তখন আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা, যারা তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় চারনেতা—ওনাদের পিছে পিছে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতাম। তার কথা শুনতাম। এভাবেই আমার বঙ্গবন্ধুকে দেখা।’
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারাবাংলা ডট নেট আয়োজিত বিশেষ লাইভ ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক। বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন গাজী গোলাম দস্তগীর। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এগারো নম্বর সেক্টরের অধীন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। সেসময় তার সহযোদ্ধা ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যজন, পরিচালক ও সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। সারাবাংলার এই লাইভে উপস্থিত ছিলেন তিনিও। আরও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) ডা. শামসুল আলম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৪ নম্বর আসামি তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই সেলে টানা নয় মাস কাটিয়েছিলেন।
শনিবার (১৪ আগস্ট) রাত ৯টায় সারাবাংলার লাইভে উপস্থিত হয়ে জাতির এই তিন সূর্যসন্তান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন এবং ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী রাজনীতির নানা স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন লেখক ও গবেষক মোফাজ্জেল হোসেন সুমন।
১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো স্বচক্ষে বঙ্গবন্ধুকে দেখেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। সেসময় মাত্র স্কুলে পড়েন। ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিপরীতে ফাতিমা জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তানের চিফ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরে শেখ কামালের সঙ্গে পরিচিতের সূত্রেও বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। তখন তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নয়, পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের উল্টোপাশে থাকতেন। তখন ফাতিমা জিন্নাহকে নিয়ে মিছিল-মিটিং হতো। তিনি বলেন, ‘ফাতিমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জোনাকি সিনেমা হলের সামনের রাস্তায় বঙ্গবন্ধুকে প্রথম বক্তৃতা দিতে দেখি। তার উচ্চতা (ছয় ফুটের উপর), চেহারা, বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ সব মিলিয়ে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম তাকে। আস্তে-ধীরে আমরা বড় হতে থাকলাম। ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দেন, তখন আমি স্কুল পাশ করি। সেসময় বাঙালির মুক্তি সনদের ছোট ছোট পোস্টার লাগানো হয়েছিল শহরজুড়ে। তিনি লাহোরে যেয়ে ছয় দফা পেশ করেন যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসবই আমাদের মনে ছাপ ফেলে’।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে বিচার করতে হবে ভিন্নভাবে। ১৯২০ সালে টুঙ্গিপাড়ার ঘাঘর নদীর তীরে কোনো এ অজ পাড়াগাঁয়ে তার জন্ম। সেখান থেকে উঠে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৩ সালে পঞ্চাশের মনন্তরে মুসলিম লীগের ছাত্রনেতা থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু প্রথম সবার নজর কাড়েন। পরে ’৪৬-এর দাঙ্গায় বঙ্গবন্ধুকে নতুন রূপে দেখা যায়। সেসময় দাঙ্গাক্রান্ত মানুষকে কলকাতার হোস্টেলে আশ্রয়ের অনুরোধ জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু তখন শুধু মুসলমানই নয়, হিন্দুদেরও জায়গা দেন। সেই থেকেই তার অসাম্প্রদায়িক চেহারাটি সামনে চলে আসে। এরপর ১৯৪৮ সালে মৌলানা ভাসানীকে সঙ্গে নিয়ে মুসলিম লীগ করেন। সেই দলের একই পদে খন্দকার মুশতাক ও বঙ্গবন্ধু জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে জায়গা পান। দেখা যায় খন্দকার মুশতাক সেটি নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন যে জেলে থাকা বঙ্গবন্ধুকে কেন তার মতোই জয়েন্ট সেক্রেটারি করা হলো। পরে ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় জেলে বসেই আমরণ অনশন করেন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি গুলির ঘটনা ঘটে ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়া হয় ও বঙ্গবন্ধু ’৫৪ এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। সেসময় তিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হন যা সত্যিই অসাধারণ। পরে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভা হলে ’৫৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হন তিনি। ৫৭ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পূর্ব বাংলা নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন বঙ্গবন্ধু সেটির প্রতিবাদ জানান ও বাংলাদেশ নামকরণের প্রস্তাব দেন। সেটিই রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ শব্দের ব্যবহার যা বিশাল একটি ঘটনা। পরে ইতিহাস নানাভাবে বিকৃতির চেষ্টা করলেও সত্য বদলে যায় না। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতাতেই তিনি ছয় দফা দাবি দেন, ৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভ করেন, ৭ মার্চ স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণা দেন ও পরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, পাকিস্তানের একটাও সৈন্য না যাওয়া পর্যন্ত যেন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যায়’।
পরে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে চাইলে পাকিস্তান সরকার যখন বাধ সাধে তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবই তাদের সমর্থনে পাশে এসে দাঁড়ান। এভাবেই ধারাবাহিকতার মধ্যে আসে ’৬৬ সালের ছয় দফা। ’৬৮ সালে তোফায়েল আহমেদ, মৌলানা ভাসানীদের সঙ্গে আমরা আন্দোলনে অংশ নিতাম, স্লোগান দিতাম, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’।
‘বাংলাদেশে পাকিস্তানের শাসনামলের ২৩ বছরের মধ্যে ১৪ বছরই জেল খেটেছেন শেখ মুজিব। সেই অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি জনমানুষের নেতা হন ও তাকে ছাত্র পরিষদ সর্ব সম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে।’
ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে অনেকবারই দেখেছি। অতবড় নেতা তিনি, তার সামনে যাওয়াই বিশাল ব্যাপার ছিল। তাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা। ৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অস্ত্র জমা দেওয়ার দিন তাকে আবারও মুখোমুখি দেখি। পুরাতন গণভবনে সরাসরি জাতির পিতার হাতে অস্ত্র জমা দেই, যা আমার জীবনের একটি গৌরবময় ঘটনা’।
কর্নেল (অব.) শামসুল আলম বলেন, ‘তিনি একাত্তরের আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে যান। তারা সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের একটাই কথা ছিল, সামরিক বাহিনী যুদ্ধ করলেও নেতা হবেন একমাত্র বঙ্গবন্ধু’।
এর আগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তার পোস্টিং ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। তার বাসায় সামরিক অনেক গোপন মিটিং হতো এবং একপর্যায়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হন ও ঘটনাক্রমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই সেলে জায়গা পান। এর আগে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের নামই শুনেছেন, সেবারই প্রথম দেখা। শামসুল আলম তখন সেনাবাহিনীর চিকিৎসা কোরে মেজর পদে ছিলেন। তাকে দেখে এগিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মেজর সাহেব, আপনি তো কখনও জেল খাটেননি। আমাদের তো অভ্যাস আছে জেলে থেকে। বিছানার চাদর, পোশাকের অবস্থা তো ভালো না। পাশে একটি ট্রাংক আছে সেখানে লুঙ্গি, গেঞ্জি থেকে শুরু করে সুচসুতো পর্যন্ত আছে। আপনি সেগুলো এনে পোশাক বদলে নেন’।
তিনি বলেন, ‘এরকম ব্যক্তিত্বকে প্রথম দেখেই আমি কেমন হয়ে গেলাম। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপরও তার কথা অনুযায়ী কাজ করলাম। বাংলাদেশের আমিই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক কামরায় টানা ন’মাস কাটানোর সৌভাগ্য অর্জন করেছি। দেশের আর কারও সেই ভাগ্য হয়েছে কিনা জানি না। সেই সেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অবিস্মরণীয় কিছু সময় কাটিয়েছি। তার সঙ্গে অনেক কথাটথা বলতাম। মেসের রান্না খেতে পারতেন না। সামান্য, ডাল বা ভর্তা করে দিতাম। তিনি তৃপ্তি করে খেতেন। বঙ্গবন্ধু ভীষণ গান ভালোবাসতেন। এদিকে ছাত্রজীবনে টুকটাক গান করতাম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই মহামানবের সামনে গান গেয়ে শোনানোর। ধন্য ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা গানটি ভীষণ পছন্দ করতেন। সেসময় পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একধরনের সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। আদালত থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু সেসব কথা মাঝেমধ্যে বলতেন তৎকালীন মেজর ডা. শামসুল আলমের সঙ্গে। পাকিস্তানিরা তাকে প্যারোলে নিতে চাইলেও তিনি কিছুতেই রাজি হননি’।
শামসুল আলম বলেন, ‘তাকে একজন রাজনীতিবিদ ও মানুষ— দুই রূপে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এমন অসাধারণ মানুষ আমি কখনও দেখিনি আমার জীবনে। এত মায়া তার। দেশের প্রতিটি মানুষের কথা ভাবতেন। যেমন সাহস, তেমনি প্রতিবাদী। কেউ কোনো উলটাপালটা কথা বললে তিনি মানতেন না কিছুতেই। জেলের সবাইকে হাঁটতে বাধ্য করতেন প্রতিদিন। তবে সবাইকে একা একা হাঁটতে হতো। কিন্তু সেটিও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানি জেলার এসে বলে হাঁটার সময় দেওয়ালের কাছে আলোর নিচে গেলে পালিয়ে যাচ্ছে ধরে নিয়ে গুলি করতে পারে। তারপর থেকে আর হাঁটতে যেতেন না বঙ্গবন্ধু’।
এরপর একদিন হুট করে বঙ্গবন্ধু এসে বললেন, ‘আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যাব। ট্রাংকে আমার স্যুট আছে। একটু আয়রন করে রেখে দিস। আমি সেই অনুযায়ী কাজ করে শুয়ে পড়লাম। পরদিন রাত সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে ফিরে তিনি জানালেন যে আমরা মুক্ত, চলে যেতে পারব। তখন সবাই ঘুমিয়ে। তাই সবাইকে জানাতে পারলেন না। কিন্তু ভিড় এড়াতে বঙ্গবন্ধুকে অনেক সকালে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই বাকিদের সরাসরি জানাতে পারছেন না, শামসুল আলম যেন জানিয়ে দেয়। পরে ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার দিকে উনাকে নিয়ে যায় ও আমি পরে সবাইকে জানাই যে আমরা মুক্ত। ’৬৯ এর সেই বিখ্যাত গণঅভ্যুত্থানের ফলেই আমরা মুক্ত হই’।
সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩৫ আসামির মাত্র তিনজন বেঁচে আছেন, যার মধ্যে কর্নেল (অব.) শামসুল আলম একজন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলখানায় কাটানো অবিস্মরণীয় সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে সবার মুখে মুখে ছিল একটাই নাম, “শেখ মুজিব”। পাকিস্তান আমলে চাকরি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই বাঙালি ছিল বঞ্চিত ও নিপীড়িত। আমাদের সেই ক্ষোভ আর হতাশার জায়গাতেই ছুঁয়ে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেন আমাদের প্রাণের নেতা। আমরা অন্তরে শেখ মুজিবের বাণী ও আদর্শ ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই’।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরলেও তখনও স্বাধীনতা বিরোধীরা এদেশেই অবস্থান করছিল। সেসব প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে বঙ্গবন্ধু কীভাবে কাজ করলেন?
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘১৯৭০-এর প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে তৈরি পার্লামেন্টের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশে এসেই সবার আগে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেন। এই পার্লামেন্টই এর আগে মুজিবনগর সরকার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। সেই সংবিধানের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি নিজের ভাষায় শাসনতন্ত্র পেল। এর পাশাপাশি তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে হাত দেন। কৃষি, অবকাঠামো থেকে শুরু করে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে হাত দেন। এর জন্য ভারত ও রাশিয়ার সাহায্য নেন। সেসময় পাকিস্তানের পাশাপাশি আমেরিকা, চায়নাসহ নানা দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি’।
তিনি বলেন, ‘তখন ৫৫ হাজার যুদ্ধবিরোধীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্য থেকে ১১ হাজার রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয় কারণ সবার অপরাধ সমান ছিল না। প্রজ্ঞাপনে বলা ছিল, যাদের সাজা দুই বছরের কম হবে তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। আমরা চাইছি পাকিস্তানসহ তাদের বাংলাদেশি দোসররা যেন তাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়। কিন্তু তাদের একধরণের অ্যারোগেন্সি আছে ও আমাদের সঙ্গে যেসব অন্যায় করেছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, স্বীকার পর্যন্ত করে না। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ তারা মেনে নিতে চান না। ফলে ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে। ৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যা হয় যার ফলশ্রুতিতে দেশে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে। এসময়েই জাসদ ও গণবাহিনী গঠন হয়। সরকারের কিছু কিছু ব্যর্থতা তো ছিলই যা কাজ করতে গেলে হওয়া স্বাভাবিক। আর সেই সুযোগও তারা নেয়। পরে পঁচাত্তরের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর নভেম্বরে নতুন ধান ওঠে গোলায় যা খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের ভাগ্য খুলে দেয়। অথচ কৃষির এই সাফল্যের পেছনে ছিল বঙ্গবন্ধুরই পরিকল্পনা। ৭২ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তার ভিত্তিতেই দেশজুড়ে কালভার্ট, ল্যান্ড স্যাটেলাইসহ অন্যান্য নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে সেনা শাসক সেসব কাজেরই সুফল ভোগ করতে থাকে শুরুর দিকে। সেনা সমর্থিত খন্দকার মোশতাকের হাত ধরেই আবার পেছনে হাটতে থাকি আমরা। যে ধর্ম নিরপেক্ষতার উপর বাংলাদেশের সৃষ্টি, তারা সেটিই মুছে ফেলে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে’।
ইতিহাসে দেখা গেছে কাউকে হত্যা করার আগে তার নাম মুছে ফেলা হয় আগে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও দেখা যায়, তার দল, পরিবার ও তাকে নিয়ে অনেক ধরনের প্রচারণা চালাতে থাকে একটি মহল। গোলাম দস্তগীর গাজীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা সেসময় কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন কিনা।
গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক বলেন, ‘জাসদ সেসময় গণকন্ঠ নামে একটি পত্রিকা চালাত যার মাধ্যমে তারা অনেক প্রচারণা চালাত। শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি বা মেজর ডালিমের স্ত্রিকে অপহরণের তথ্যও এমনই একটি রাজনৈতিক প্রচারণা যা সর্বাংশে মিথ্যা। আমাদের ঢাকায় জন্ম, বেড়ে ওঠা। তাই ঢাকার সবকিছু আমাদের সামনেই ঘটে। তবে বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করবে এটি তিনি তো বটেই, আমরাও কখনও ভাবতে পারিনি। সবাই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতো। যে ৪৪ হাজার যুদ্ধবিরোধীকে বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দেন তাদের তো আমরাই মেরে ফেলতাম। কিন্তু আমাদের মহান নেতা তার মহানুভবতা দেখিয়ে ১১ হাজার বাদ দিয়ে বাকিদের ক্ষমা করে দেন। কিন্তু দেখা যায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই এগারো হাজারও মুক্তি পেয়ে যায় যারা পরবর্তীতে আবারও বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সামগ্রিক ঘটনাটির ব্যর্থতাটি কি রাজনৈতিক নাকি সামরিক— জানতে চাওয়া হলে গাজী গোলাম দস্তগীর বলেন, ‘এটি আসলে আমাদের সবারই ব্যর্থতা। আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থাও নিশ্চয় দুর্বল ছিল নাহলে তারা সময় মতো কেনো খবর দিতে পারল না? শুরুতে তো আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি যে এমন কিছু ঘটেছে। আর এতবড় ঘটনা ঘটিয়েছেও মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা, যাদের র্যাংক মেজর বা এমন কিছু। এভাবে বাহিনীর বাইরে থেকে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো যায় তা আমাদের চিন্তারও বাইরে ছিল’।
বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, তাও তার বড় সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক-এর কাছে জানতে চাওয়া হয়— বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে এটি কখনো ভেবেছিলেন কিনা? যেসব খুনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাদের বিচার কার্যকরের ব্যাপারেও বা কতটা ইতিবাচক তিনি?
বীর মুক্তিযোদ্ধা বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অল্প কিছুদিন খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় থাকার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেয়। তখন তো পরিস্থিতি এমন ছিল যে মুক্তিযোদ্ধা মানেই দেশের শত্রু। তখন বলা হয় হয় তাদের সংগঠনে যোগ দিতে হবে নাহলে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকাই মুশকিল। শেখ হাসিনাও তখন বিদেশে। তিনি আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা কিছুই জানি না আমরা। কোনো একদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ সরকার দেশের ক্ষমতায় আসবে সেই আশা নিয়েই বেঁচে ছিলাম আমরা। স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায়— এটা মেনে নেওয়াও কঠিন ছিল আমাদের জন্য। তারপরও আমাদের যাদের বুকের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন করা ছিল তারা ভেতরে ভেতরে সংগঠিত ছিলাম। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে অবশেষে শেখ হাসিনার হাত ধরে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন আমরা বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হওয়ার আশা করতে থাকি। সেবার তিনি শুরু করে গেলেও শেষ করতে পারেন নি। পরে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে আবারও চালু করেন। অনেকেরই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে আবার অনেককেই পাচ্ছি না। তবে আশা প্রকাশ করি একদিন তাদের বিচারও কার্যকর হওয়া দেখতে পারব’।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে জাতি পালন করছে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ। সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীনতার এই তিন সূর্য সন্তান। বর্তমান তারুণ্যের কাছে তাদের কোনো প্রত্যাশা আছে কিনা জানতে চাইলে গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক বলেন, ‘তারুণ্যের কাছে একটাই চাওয়া, তারা যেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করেন ও যে চার নীতিতে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম সেই চার নীতি যেন বাস্তবায়ন হয় এদেশে। তারা যেন বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত করে ও আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলে’।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে আমার চাওয়া যে, ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও দু’লক্ষ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি— সেই ভূমিতে আজ যারা জন্ম নিচ্ছে তারা যেন সাধারণ মানুষের অধিকার সমুন্নত রেখে দেশটিকে একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দেশ হিসেবে গড়ে তোলে। যেখানে ধর্ম-বর্ণ-পেশা ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের সমঅধিকার থাকে’।
অনুষ্ঠান শেষ সঞ্চালক মোফাজ্জেল হোসেন সুমন বলেন, ‘ব্যক্তিকে হত্যা করা গেলেও তার আদর্শকে হত্যা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু এমনই একটি আদর্শের নাম, বাঙালি জাতীয়তাবাদের নাম। বাঙালি জাতীয়বাদ, জাতিসত্তা যতকাল টিকে থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর নামও টিকে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর কোনো মৃত্যু নাই।’
https://youtu.be/44uRpRmjdrw
সারাবাংলা/আরএফ/আইই
কর্নেল (অব.) অলি আহমদ কর্নেল (অব.) শামসুল আলম গাজী গোলাম দস্তগীর বীরপ্রতীক গোলাম দস্তগীর গাজী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতীয় শোক দিবস জাতীয় শোক দিবস ২০২১ নাসির উদ্দীন ইউসুফ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেখ মুজিবুর রহমান