বিধি ভঙ্গ: সন্তান পরীক্ষার্থী, প্রশ্নপত্র প্রণয়নে বাবা
১৭ আগস্ট ২০২১ ১৯:১৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছয় দশকের প্রথা ও বিধি ভেঙে প্রশ্নপত্র প্রণেতা ও পরিশোধক নিয়োগ দিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি জানাজানির পর বিধি ভঙ্গ করে নিয়োগ পাওয়া ১১ জন শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে তাদের প্রণয়ন করা প্রায় ৪০০ সেট প্রশ্নপত্র।
এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভুলভ্রান্তি এড়িয়ে নতুনভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা যাবে কি না- তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বিধি ভঙ্গ করে প্রশ্নপত্র প্রণেতা ও পরিশোধক নিয়োগের কারণে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কয়েক লাখ টাকা গচ্চা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে সময়েরও অপচয় হয়েছে। নিয়োগ বাতিল হওয়া কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, নিয়োগের সময় বোর্ড কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট শর্ত উল্লেখ না করায় তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
জানা গেছে, যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার জন্য ১৯৬১ সালে প্রণীত ‘পাবলিক পরীক্ষা প্রবিধনামালা’ অনুসরণ করে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শিক্ষকদের মধ্য থেকে পরীক্ষা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তিনটি দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ দেন। এর মধ্যে আছে- পেপার সেটার বা প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী, মডারেটর বা প্রণীত প্রশ্নপত্র যাচাইবাছাইকারী (পরিশোধক) এবং পরীক্ষক, যিনি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন।
‘পাবলিক পরীক্ষা প্রবিধানমালার’ ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে- প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী, পরিশোধক, অনুবাদক, প্রধান পরীক্ষক, সহকারী প্রধান পরীক্ষক, পরীক্ষক, যাচাইকারী, সারণীকর্তা এবং প্রশ্নপত্রের পাতলা পাত ছেদনকারী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, যার নিকটতম সম্পর্কের কেউ ওই বছর ওই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে চলতি বছরের নভেম্বরে সারাদেশে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত মাস (জুলাই) থেকে দুই পাবলিক পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড। এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য ১৯৮ জন প্রণেতা বা সেটার এবং ১১২ জন পরিশোধক বা মডারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা বিভিন্ন কলেজের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষক। সৃজনশীল বিষয়ের ক্ষেত্রে যাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ আছে, তাদের সবচেয়ে দক্ষ শিক্ষক পান মডারেটরের দায়িত্ব। আর অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ বা দক্ষ শিক্ষককে দেওয়া হয় প্রণেতার দায়িত্ব। প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য ছয় জন করে দায়িত্বরত থাকেন। এর মধ্যে চার জন সৃজনশীল প্রশ্নপত্র ও দু’জন নৈর্বক্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেন। আর প্রতিটি প্রশ্নপত্র যাচাইবাছাই ও পরিশোধনের দায়িত্বে থাকেন চার জন করে মডারেটর।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে এবার চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ পাবলিক পরীক্ষা প্রবিধানমালায় উল্লিখিত বিধি সঠিকভাবে অনুসরণ করেনি। এমনকি তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে শর্তাবলীতে এই প্রবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধির কথাও উল্লেখ করা হয়নি।
এ অবস্থায় প্রণেতারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে জুলাই মাসে লকডাউন শুরুর আগে শিক্ষাবোর্ডে জমা দেন। ১৬ আগস্ট থেকে পরিশোধকদের প্রণীত প্রশ্নপত্র পরিশোধন কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে। সূচনা সভায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ ঘোষণা দেন, যাদের সন্তান চলতি বছরের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন তাদের কেউ মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। হঠাৎ এই ঘোষণা নিয়ে সভায় অস্বস্ত্বিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ১১ জন মডারেটর জানান যে, তাদের সন্তান এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সভার মধ্যেই ১১ জনকে পাওয়া যায়, যারা মডারেশনের দায়িত্ব পেয়েছেন অথচ তাদের সন্তান এইচএসসি পরীক্ষার্থী। আবার এই ১১ জনের মধ্যে ১০ জন সেটার হিসেবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেছেন। এ নিয়ে সভায় বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন চেয়ারম্যান স্যার মৌখিকভাবে ১১ জনের নিয়োগ বাতিল এবং নতুনভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ঘোষণা দেন। তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে মডারেশন সংক্রান্ত সভা হয়েছে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘১১ জন মডারেটরের সন্তান এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। বিষয়টা এমন যে, একজন মডারেটর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, কিন্তু তার ছেলে পড়ালেখা করেন মানবিক বিভাগে। আইনে কিন্তু উনার মডারেটর হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা নেই। তারপরও আমরা বলেছি- না, আপনারা কেউ থাকতে পারবেন না। আমরা উনাদের নিয়োগ অফিসিয়ালি বাতিল করেছি।’
বাতিল শিক্ষকদের তৈরি প্রশ্নপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনারা মডারেটর, একজনও সেটার নন। উনারা কেউ প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জড়িত ছিলেন না।’
অধ্যাপক প্রদীপ চক্রবর্তী বাতিল ১১ জন প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জড়িত না থাকার দাবি করলেও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনার যেসব প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন সেগুলো আমরা বাতিল করেছি। নতুনভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হচ্ছে। ৪০০ সেট বাতিল করা হয়েছে। ২২ আগস্টের মধ্যে আমরা নতুন প্রশ্নপত্র পেয়ে যাব। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের আগেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব। এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।’
বাদ পড়া ১১ জনের মধ্যে আটজনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন- চট্টগ্রাম কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক দৌলতুর রহমান, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রামের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুর রউফ, চট্টগ্রামের গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল খালেক, চট্টগ্রাম কলেজের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কৃষ্ণা বড়ুয়া, একই কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইউনুছ হাছান, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল হাসনাত মো. মফিজুল হক, সাতকানিয়া সরকারি কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ মুজিবুর রহমান এবং আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেবাশীষ ধর।
এদের মধ্যে অধ্যাপক দৌলতুর রহমানের ছেলে এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে। আমি প্রশ্ন করেছি মানবিক বিভাগের দর্শন বিষয়ের। আমাকে মডারেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়োগপত্রে এ সংক্রান্ত কোনো শর্তাবলী উল্লেখ ছিল না। আগেও আমি সেটার এবং মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন উল্লেখ থাকতো। এবার শর্তাবলী না থাকায় আমি ভেবেছি, যেহেতু আমার ছেলে বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী আর মানবিক বিভাগের প্রশ্নপত্রের মডারেটর, এতে বোধহয় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কাজ শুরুর পর বাদ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগের শর্তাবলীতে উল্লেখ থাকলে এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।’
অধ্যাপক মো. আবদুর রউফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি সেটার এবং মডারেটর উভয়ের দায়িত্বে ছিলাম। আমি সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত নয়। একজনের অনুপস্থিতিতে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাকে কোনো ধরনের শর্তের কথা জানানো হয়নি। যখন জানতে পেরেছি, আমি নিজ থেকে সারেণ্ডার করেছি। যদিও আমি মনোবিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরি করেছি, কিন্তু আমার ছেলের পাঠ্যসূচিতে ওই বিষয় নেই, তারপরও আমি সারেণ্ডার করেছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর প্রশ্নপত্র প্রণেতা, উত্তরপত্র মূল্যায়নকারী, পরিশোধকসহ সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাবোর্ডের গোপনীয় শাখা থেকে তদন্ত করা হয়। তদন্তের পর কোনো শিক্ষকের বিষয়ে আপত্তি পেলে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় না। কিন্তু এবার গোপনীয় শাখা থেকে তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গোপনীয় শাখার লোকজন তো অফিস স্টাফ। তাদের তো এসব বিষয় জানা থাকার কথা নয়। বিষয়টি জানার পর আমরা তো ১১ জনকে বাতিল করে নতুনভাবে ১১ জনকে নিয়োগ দিয়েছি। সেটেল্ড মেটার, এটা নিয়ে নিউজ হওয়া উচিত নয়।’
একই বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেটার-মডারেটর সবাই তো পুরনো, অভিজ্ঞ। উনাদের তো বিষয়টি জানা থাকার কথা। আমাদের জানার বিষয় নয়। উনারা দায়িত্ব নিলেন কেন?’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড ছেলে প্রণয়ন প্রশ্নপত্র বাবা শিক্ষার্থী