নওগাঁর আলফ্রেড সরেন হত্যাকাণ্ডের বিচার মেলেনি ২১ বছরেও
১৮ আগস্ট ২০২১ ০৮:৩৩
নওগাঁ: ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট। ভূমিদস্যুদের সন্ত্রাসী বাহিনী তাণ্ডব চালায় নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লিতে। ১১টি পরিবারের বাড়িঘরে চালায় ভাঙচুর-লুটপাট। দেওয়া হয় আগুন। হামলায় আদিবাসী নারী-শিশুসহ ৩০ জন মারাত্মক আহত হন। সেই হামলাতেই নৃশংসভাবে খুন হন আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন। সে ঘটনায় দায়ের হয়েছিল হত্যা মামলা। এরপর সপ্তাহ, মাস, বছর পেরোতে পেরোতে পেরিয়ে গেছে ২১ বছর। কিন্তু আজও আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।
শুধু তাই নয়, ওই হত্যা মামলার আসামিদের প্রায় সবাই জামিনে মুক্ত। তারা এখনো আদিবাসী পল্লির বাসিন্দা তথা মামলার সাক্ষীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছেন। তাতে ভীমপুর আদিবাসী পল্লি ছেড়ে গেছে অনেক পরিবারই। যারা এখনো সেখানে রযেছেন, তারাও ভূমিদস্যুদের ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না। দিন কাটছে অভাব-অনটনে। মামলার সাক্ষীরা পল্লি ছেড়ে চলে যওয়ায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান আলফ্রেড সরেনের প্রবাসী ছোট বোন ও মামলার বাদী রেবেকা সরেন।
সরজমিনে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখন মাত্র সাত-আটটি পরিবারের বসবাস। অথচ এখানে একসময় থাকত ২৪টি পরিবার। পল্লির বাসিন্দারা বলছেন, আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার জামিনে থাকা আসামিদের হুমকি-ধমকিতেই বাকিরা পল্লি ছেড়ে চলে গেছেন।
আলফ্রেড সরেন হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় তার মা ঠাকুরানী সরেন মৃত্যুবরণ করেন। আলফ্রেডের বৃদ্ধ বাবা গায়না সরেনও মারা গেছেন। আর স্ত্রী জোছনা সরেন এখন আর এই পল্লিতে থাকেন না। আলফ্রেডের রেখে যাওয়া চার বছরে মেয়ে ঝর্ণা সরেন এখন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন।
আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহসীন রেজা জানালেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলফ্রেডের বড় ভাই কমল সরেন ও ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এর মধ্যে পুলিশ কয়েক জন আসামিকে গ্রেফতারও করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় এবং ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়াও হয়।
এর মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। অ্যাডভোকেট মহসীন রেজা বলেন, ওই সময় পলাতক সীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনেরও বেশি আসামি জননিরাপত্তা আইন বাতিল হওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট এ সংক্রান্ত সব রিট খারিজ করে দিলে আসামিরা জামিনে বেড়িয়ে যান। এরপর বাদীরা আপিল বিভাগের শরণাপন্ন হন। বর্তমানে হত্যা মামলাটি আপিল বিভাগ শুনানি শেষে পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে পাঠিয়েছেন। এ অবস্থায় সরকারের কাছে আমাদের দাবি, শুনানি দ্রুত শেষ করে মামলাটির রায় ঘোষণা করা হোক।
নিহত আলফ্রেড সরেনের ছোট ভাই মহেশ্বর সরেন বলেন, আসামিরা এখনো আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ৬৩ বিঘা জমির মধ্যে ৩৩ বিঘা জমি তারা নিয়ে নিয়েছে। বাকি ৩০ বিঘা জমি জন্যও ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশ করে চেক কেটে নিয়েছে। পল্লির অনেকেও আসামিদের হুমকিতেই এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
মহেশ্বর সরেন বলেন, ভাইকে (আলফ্রেড সরেন) হত্যার পর আদিবাসীরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে বিচারের দাবিতে। আমরা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন মুকুল বলেন, আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনকে হত্যার পর অগ্নিসংযোগ করে, নারী ও শিশুদের উপর নির্যাতন করা হয়। ওই সময় জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় নেতাদের নিয়ে ১৮/২০ হাজার লোকের সমন্বয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলাম। কিন্তু আজও আলফ্রেড হত্যার বিচার পেলাম না।
তিনি আরও বলেন, সারাদেশে আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি— অবিলম্বে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। পৃথক স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। একইসঙ্গে আমরা আলফ্রেডের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।
এদিকে, আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার না মিললেও আজ ১৮ আগস্ট তার মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে বেশকিছু কর্মসূচি পালন করা হবে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নওগাঁ জেলা শাখা জানিয়েছে, ১৮ আগস্ট সকালে ভীমপুরে আলফ্রেড সরেনের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন ও ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হবে। একইসঙ্গে সমাধি প্রাঙ্গণে থাকবে আলোচনা সভা ও আদিবাসী সমাবেশ। এছাড়া কদমতলীর মোড় থেকে আলফ্রেড সরেনের সমাধি পর্যন্ত পদযাত্রার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে জেলা বাসদ।
সারাবাংলা/টিআর