হ য ব র ল জাপার করুণ অবস্থা, ফের ভাঙনের শঙ্কা!
২৪ আগস্ট ২০২১ ২০:৪৫
ঢাকা: জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমসহ সবকিছুই বলতে গেলে স্থবির। রাজনীতিবিদদের অনেকেই বলে থাকেন, হ য ব র ল অথবা করুণ অবস্থায় রয়েছে জাপা। আর দলের নেতাকর্মীদের দাবি, এই অবস্থার জন্য দায়ী বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং এরশাদ পরিবারের মধ্যে অনৈক্য। এছাড়া কিছু দিন পর পর বিদিশার তোলা ঝড়ও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে দলটিকে। জাতীয় পার্টির একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, এরশাদের অবর্তমানে গত দুই বছরেও এক হতে পারেননি বিরোধীদলীয় নেতা ও এরশাদপত্নী বেগম রওশন এরশাদ এবং উপনেতা ও এরশাদের ছোটভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের। দলের নেতৃত্ব–কর্তৃত্ব নিয়ে দু’জনের মধ্যকার কোন্দল–গ্রুপিং এখনও জিইয়ে আছে। আর সেটার প্রভাব পড়েছে দলের নেতাকর্মীদের মাঝেও। রওশন এরশাদ বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। তার জন্য দোয়া মাহফিলও করা হচ্ছে। তারপরও ভেতরে ভেতরে চলছে তাদের দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্ব শুধু নেতৃত্বের নয়, এরশাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়েও।
দলটির সার্বিক বিষয় নিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব থাকলেও জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে রওশন ও জিএম কাদেরকে একত্রে দেখা গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে এই দুই নেতাকে একত্রে দেখা যায়নি। বরং অভিযোগ উঠেছে, এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে চায়নি দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং সাধারণ সম্পাদক জহিরুল আলম রুবেল উদ্যোগ নিয়ে এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে।
এসব বিষয় নিয়ে ঢাকা মহানগরের প্রভাবশালী এক নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির কোনো অবস্থান নেই, নেই কোনো ভবিষ্যৎ। আস্তে আস্তে দলটি ছোট হয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাঁচটি আসন দিতে চাইলে তাই নিতে হবে। বিএনপিও জাতীয় পার্টিকে বেশি আসন দিতে চাইবে না। কারণ আমরা সাংগঠনিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছি। আর এই দুর্বলতার কারণ হচ্ছে, দলটির চেয়ারম্যান। ঘরোয়া বৈঠকে জিএম কাদেরের উপস্থিতিতে তার দোষগুলো তুলেও ধরা হয়েছে।’
এই নেতা বলেন, ‘খুবই দুঃখ লাগে। এরশাদ সাহেবের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আমরা জেলা–উপজেলায় পালন করতে চেয়েছিলাম। এজন্য যত টাকা প্রয়োজন হতো তাও আমরা ম্যানেজ করতাম। কিন্তু জিএম কাদের তা করতে দেননি।’
অপরদিকে, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়ায় রওশনপন্থী এসব নেতা এখন জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা সাদ এরশাদকে সামনে রেখে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। রওশনের সঙ্গে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব নিরসন না হলে যেকোনো সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। অদূর ভবিষ্যতে এরশাদপুত্র সাদ জাতীয় পার্টির হাল ধরতে পারেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। আর এতে এরশাদের ছোট ছেলে এরিক এরশাদ ও তার মা বিদিশা সিদ্দিককেও একই ছাতায় দেখা যেতে পারে।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর গত দুই বছরে জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও পারেনি। দলটির মধ্যে যেমন চলছে নেতৃত্বের কোন্দল, তেমনি চলছে মান–অভিমান, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। এরশাদের মৃত্যুর পর দলটির টার্গেট ছিল, এক বছরে জাতীয় পার্টিকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির স্থান দখল করবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। দলীয় নেতাকর্মীদের অভিমত, জাপা চেয়ারম্যানের অযোগ্য নেতৃত্ব তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। তাদের মতে, দলটি এখন ফের ভাঙনের মুখে। যেকোনো সময় বিদিশার নেতৃত্বে আরেকটি জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে।
রওশন এরশাদের পুত্র রাহগির আল মাহে সাদ এরশাদ এমপি এবং এরিক এরশাদের মা বিদিশা নেতাকর্মীদের নিয়ে গোপনে আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠনের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিষয়টি এখন দলের মধ্যেও বেশ আলোচিত। এরশাদের দ্বিতীয় সাবেক স্ত্রী বিদিশা বলতে গেলে জিএম কাদেরের নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। তার সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের তৎপরতা অব্যহত রয়েছে। যদিও বিদিশা ও তার ছেলে এরিক এরশাদসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে গত ১৬ আগস্ট। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক কাজী মুশফিক মাহবুব রবিনের আদালতে এ মামলার আবেদন জমা দেন সাবেক হুইপ এস এম গোলাম রেজা ও তার স্ত্রী জিন্নাতুল নাহার শিমু। আসলে দলটির মধ্যে বিদিশা ঝড় বয়ে চলছে। অন্যদিকে, এরশাদের সম্পত্তি নিয়েও চলছে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা গেছেন ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই। এরপর থেকেই দলটির নেতৃত্বে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। এরশাদপত্নী রওশন দলটির শীর্ষ পদে রয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার সাংগঠনিক কোনো ক্ষমতা নেই। যদিও তিনি বর্তমানে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করছেন। আর দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের।
অপরদিকে, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের জাতীয় পার্টিতে অবমূল্যায়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে অযোগ্য ও বিতর্কিতদের পদায়ন, বিভিন্ন সময় পদ বাণিজ্যের অভিযোগ, পার্টির চেয়ারম্যান কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট, পদ–পদবি ও কমিটি গঠন নিয়ে কেন্দ্র থেকে জেলা–উপজেলা পর্যায়ে নেতাদের কোন্দল–গ্রুপিং, পার্টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে।
ঢাকা–৪ আসনের সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, বরিশালে নাসরিন হাওলাদার রত্না আমিন এমপি, গাইবান্ধায় ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপিসহ কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ছাড়া সাংগঠনিক কার্যক্রমে কেউ খুব একটা তৎপর নন। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, তৃণমূলে কোন্দলসহ নানা ঘটনায় চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দল ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে। এসব কারণে জাতীয় পার্টি আগের চেয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। তাদের ধারণা, দলটির অবস্থা করুণ; ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলটিতে যোগ্যপ্রার্থীর অভাব দেখা দিতে পারে।
এসব বিষয়ে দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব সাঈদুর রহমান টেপা কৌশল করে সারাবাংলাকে বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের দলকে শক্তিশালী করার জন্য আটটি বিভাগে অতিরিক্ত মহাসচিবদের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করছি। আগামী নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।’ আপনাদের এই কি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে? জবাবে টেপা বলেন, ‘আল্লাহ চাইলে এবং জনগণ সহায়তা করলে অবশ্যই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম
জাতীয় পার্টি জি এম কাদের বিদিশা সিদ্দিক ভাঙন রওশন এরশাদ হ য ব র ল