Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কিটের দাম ২৮শ থেকে ৭শ, তবু বেসরকারিতে কমছে না পিসিআরের খরচ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৫ আগস্ট ২০২১ ২৩:৫৯

ঢাকা: সরকারের নির্দেশনায় এক দফায় খরচ কমলেও দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাস শনাক্তে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার খরচ এখনো নাগালের বাইরে বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। অথচ একই সময়ে এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিটের দাম নেমে এসেছে চার ভাগের এক ভাগে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে যে খরচ তারা রাখছে, এর কমে নমুনা পরীক্ষা করানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই একশ্রেণির সুবিধাভোগীকে লাভ করার সুবিধা দিয়ে নমুনা পরীক্ষাগুলো করানো হচ্ছে। এ কারণে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা ও অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিসিআর পরীক্ষার খরচ আরও কমিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে অন্তত কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুসরণের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর কেবল সরকারি ল্যাবেই নমুনা পরীক্ষার সুযোগ ছিল। গত বছরেরই ২৯ এপ্রিল প্রথম তিনটি বেসরকারি হাসপাতালকে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা শনাক্তে নমুনা পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সময় পিসিআর কিটের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর নমুনা পরীক্ষার খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। এরপর ২১ মে আরও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়। তাদের জন্যও নমুনা পরীক্ষার ফি ছিল সাড়ে তিন হাজার টাকা। তবে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হলে সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করে দেয় সরকার।

এর প্রায় এক বছর পর এ বছরের ৬ মে নমুনা পরীক্ষার ফি কমিয়ে দেয় সরকার। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল বা কেন্দ্রে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করালে ৩,০০০ টাকা এবং বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হলে ৩,৭০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ পিসিআর কিটের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় ওই সময় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তো বটেই, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটিও বেসরকারিতে এই পরীক্ষার ফি দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল।

পিসিআর কিটের দাম কত?

২০২০ সালের কোভিড-১৯ সংক্রমণ যখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, ওই সময় পিসিআর কিটের সরবরাহে ঘাটতি ছিল। কিটের চাহিদাও ছিল আকাশচুম্বী। তখন একেকটি কিট ২,৮০০ টাকা পর্যন্ত দামেও কিনতে হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে সেই কিটের দাম কমতে থাকে। কিটের সরবরাহ বাড়তে থাকায় বর্তমানে সেই দাম কমতে কমতে চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে!

বিজ্ঞাপন

দেশে কিট সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, দেশে এ বছরের মে মাসের দিকে সরকারিভাবে ট্যাক্সসহ ৯৮০ টাকা দরে সিএমএসডিতে কিট সরবরাহ করা হচ্ছিল। বেসরকারি ল্যাবগুলোতে আমরা ৯৬০ থেকে ৯৭০ টাকায় কিট সরবরাহ করেছি। কিছু ক্ষেত্রে ভিটিএমসহ এর দাম এক হাজারের কিছু বেশি হতে পারে। তবে বর্তমানে সিএমএসডি থেকেই সরকারিভাবে কার্যাদেশের মাধ্যমে ৮৪০ টাকা দিয়ে কিট কেনা হচ্ছে।

ওই কর্মকর্তা ছাড়াও কিট সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে অল্প কিছু কোম্পানি এই কিট সরবরাহ করত বলে দাম ছিল অনেক বেশি। এখন এটি স্বাভাবিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকাতেই পাওয়া যাচ্ছে এই কিট।

কিটের দাম কমলে খরচ কেন কমবে না?

কিটের দাম চার ভাগের একভাগে নেমে এলেও বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কেন কমছে না— এ প্রশ্ন তুলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। সরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে। বেসরকারি ল্যাবে খরচ কমলে স্বল্প সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা নমুনা পরীক্ষায় বেশি আগ্রহী হবেন। আর সেটি ঘটলে পরিস্থিতি বুঝতে সহায়ক হবে।

এ প্রসঙ্গে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে জানতে হবে কত মানুষের মাঝে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতেই হবে। সরকার ১০০ টাকায় নমুনা পরীক্ষা করে দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি এসব স্থানের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। নমুনা পরীক্ষার পর ফল পেতে দেরি হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এসব কারণে কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা বা আইসোলেশন নিশ্চিত করতেও সময় বেশি লাগে। সেক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষাকে সহজলভ্য ও দ্রুত রিপোর্ট নিশ্চিত করা গেলে তা নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।

কিটের দাম কমলেও বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কমেনি— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. লেলিন বলেন, একসময় আমাদের দেশে যে কিট আসত, তার দাম অনেক বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে এর দাম কমেছে। আর তাই বেসরকারি খাতে করোনা পরীক্ষার দাম পুনরায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এটি কোনোভাবেই এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার বেশি হতে পারে না।

এর আগে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকেও এই পরীক্ষার খরচ কমিয়ে দেড় থেকে দুই হাজারে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সেবারে নামমাত্র খরচ কমানোয় সারাবাংলার কাছে ক্ষোভ জানিয়েছেন ওই কমিটির একজন সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সদস্য বলেন, নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে যেহেতু কিটের দাম কমে এসেছে, তাই এখনো সেই আগের খরচে বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক। কিটের দাম ৮০০ বা ৯০০ টাকাও যদি হয়, তবে নমুনা পরীক্ষার খরচ দেড় হাজার টাকায় নামিয়ে আনা উচিত বলে মনে করি। তাতে মানুষ বেসরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষা করাতেও আগ্রহী হবে বেশি।

কী বলছে বেসরকারি কর্তৃপক্ষ?

কিটের দাম প্রায় এক-চতুর্থাংশে নেমে এলেও বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষার খরচ কেন কমছে না— এমন প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য একাধিক ল্যাবের কর্মকর্তারা উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এটি সরকারের বিষয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার নমুনা পরীক্ষা যারা করে তাদের কিন্তু অনেক টাকা দিয়ে রাখতে হয়। সবাই কিন্তু এই নমুনা পরীক্ষা করতে চায় না। আর তাই কিটের দাম কমলেও এর ফি কমানো বাস্তবতা না। যেমন অ্যান্টিজেন টেস্টের কিটের দাম ৫০০ টাকা হলেও আমরা সেটা ৭০০ টাকা দিয়ে করানোর অনুমতি পেয়েছি। এক্ষেত্রে আসলে এত অল্প লাভে কষ্ট করে নমুনা পরীক্ষা আমরা করাচ্ছি দেশের কথা ভেবে।’ এ অবস্থায় বেসরকারিভাবে পিসিআর নমুনা পরীক্ষার ফি কমানো বাস্তবসম্মত না বলেও দাবি করেন মনিরুজ্জামান ভুঁইয়া।

টেকনোলজিস্ট বা নমুনা পরীক্ষার জন্য নিয়োজিত ভাইরোলজিস্টদের বেশি বেতন দেওয়ার কারণে বেসরকারিতে পিসিআর পরীক্ষার খরচ কমছে না— এমনটি মানতে রাজি নন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর একটি বেসরকারি ল্যাবে কর্মরত একজন ভাইরোলজিস্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, বেশি বেতনে কীভাবে রাখা হচ্ছে সেটি বোধগম্য না। উলটো বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা রকমের গরিমসি রয়েছে। কিছু ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যার ওপরে বেতন নির্ভর করে। কিটের দাম কমে যাওয়ার পরে নমুনা পরীক্ষার মূল্য এত বেশি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। আর সেজন্য টেকনোলজিস্ট বা অন্যান্যদের বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে— এমন কথারও কোনো ভিত্তি নেই। দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকাতেই বেসরকারি ল্যাবে পিসিআর পরীক্ষা করানো সম্ভব— এমন অভিমত এই ভাইরোলজিস্টের।

কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদফতর?

বেসরকারি ল্যাব বা প্রতিষ্ঠানে পিসিআর পরীক্ষার খরচ নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা কোনো মন্তব্য করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসন শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, বেসরকারিতে নমুনা পরীক্ষার দাম বর্তমানে অনেক বেশি। বিভিন্ন সময় এটি কমানোর জন্য বলা হলেও মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এ অবস্থায় নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তবু নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ফোন ধরেননি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়াও। সারাবাংলার পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের সঙ্গেওযোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

আরটি-পিসিআর নমুনা পরীক্ষা পিসিআর পরীক্ষা বেসরকারিতে পিসিআর পরীক্ষা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর