আফগানিস্তানে শূন্যস্থান পূরণে আগ্রহী রাশিয়া, তবে ফলাফল অনিশ্চিত
২৮ আগস্ট ২০২১ ১৭:০৪
আফগানিস্তানে উগ্রবাদী গোষ্ঠী তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপর দেশটিতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছে রাশিয়া। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তির স্থলাভিষিক্ত হয়ে কার্যত গোটা অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণে রাশিয়ার আগ্রহ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার ব্যাঙ্গ করেছেন।
পুতিন গত ২০ আগস্ট জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি পশ্চিমা বহু রাজনীতিবিদ বাস্তবতা বুঝতে পারছেন যে, অন্যান্য দেশ ও জাতির জন্য অদ্ভুত রাজনৈতিক সিস্টেম তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া একটি অগ্রহণযোগ্য কাজ’।
গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের মাধ্যমে আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন নতুন এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে একের পর এক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ঝড় তুলেছেন। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের পর পুতিন উজবেকিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, ফ্রান্স এবং ইতালির নেতাদের সঙ্গে টেলিফোন আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, আফগানিস্তানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা তার রয়েছে।
যখন বেশিরভাগ দেশ কাবুল দূতাবাস থেকে কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিতে তাড়াহুড়া করছে, তখন রুশ দূতাবাস যথারীতি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১৫ আগস্ট কাবুলে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি জিরনোভ বলেন, ‘আমরা শান্তভাবে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব’। জিরনোভ তার এ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের কর্মী বা স্থাপনাগুলোতে কোনো নিরাপত্তাজনিত হুমকি নেই’। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, ১৭ আগস্ট তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর তালেবানের সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক আরও বেড়েছে।
আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পূর্বাভাস পেয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল ক্রেমলিন। ক্ষমতায় তালেবানের ফেরার ব্যাপারে মস্কো প্রস্তুত ছিল। আফগানিস্তানে পাঠানো প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিশেষ দূত জামির কাবুলোভ জানান, গত সাত বছর ধরে তালেবানদের সঙ্গে আন্দোলনের ব্যাপারে যোগাযোগ রাখছিল মস্কো। তিনি আরও বলেছিলেন, রাশিয়া ধারণা করেছিল যে, আফগানিস্তানের ভবিষ্যতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে তালেবান।
উল্লেখ্য যে, মস্কো তালেবানকে এখনও একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে, এবং তালেবান সদস্যদের রাশিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবুও গত জুলাইয়ে তালেবানের একটি বিশেষ প্রতিনিধি দলকে আতিথ্য দিয়েছে মস্কো।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চাদপসরণ করলে কূটনৈতিক আক্রমণের জন্য মস্কোর কয়েক বছরের প্রস্তুতি এবার ফল দিতে শুরু করেছে। সিরিয়ান গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের মতোই পুতিনের লক্ষ্য এবার এ অঞ্চলে পদচিহ্ন রেখে যাওয়া। আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে ক্রেমলিন ইতিমধ্যে তার শক্তি ব্যবহার শুরু করেছে।
আগস্টের শুরুতে যখন আফগানিস্তানের একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে তালেবান, ঠিক তখন রুশ সামরিক বাহিনী উজবেক, তাজিক ও চীনা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিলে আফগান সীমান্ত এলাকায় মহড়া চালায়। মধ্য এশিয়ার দুটি দেশ—সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান—ইতিমধ্যে মস্কোর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাজিকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক জোটও রয়েছে।
মধ্য এশিয়ার এসব দেশ আশঙ্কা করছে যে, আফগানিস্তানের উগ্রবাদী গোষ্ঠী তালেবান বা লুকিয়ে থাকা অন্যান্য মুসলিম জঙ্গিরা তাদের দেশে অনুপ্রবেশ এবং সীমান্ত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এসব হুমকি আমলে নিয়ে রাশিয়া সামরিক মহড়ার মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অভিভাবক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
উপরন্তু, আফগান-মার্কিন পরাজয়কে মস্কো এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব হ্রাসের লক্ষণ হিসেবে প্রচার করছে। আফগানিস্তানে মার্কিন পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে পুতিনের প্রচারিত আখ্যানের মাধ্যমে ইউক্রেনেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।
এই অঞ্চলে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব সত্ত্বেও এটা বলা যেতে পারে যে, অনিশ্চিত রাজনীতির এ খেলায় দেশটির আগ্রহ খুব একটা ছিল না। তবে নাকের ডগায়, অর্থাৎ মধ্য এশিয়ায় নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে রাশিয়ার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠার উপযুক্ত কারণ তৈরি হয়েছে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শইগু ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসীরা তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও কিরিগিস্তান হয়ে রাশিয়ায় ঢুকে পড়তে পারে। এসব খবর রুশ নাগরিকদের ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মুসলিম জঙ্গিবাদের প্রাদুর্ভাবের তিক্ত স্মৃতি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আফগানিস্তানে নিজের প্রভাব বাড়িয়ে মধ্য এশিয়ার অন্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বা ইতিবাচক ফল আদায় করে নিতে কি সক্ষম হবে মস্কো?
পুতিন খুব ভালো করেই জানেন যে, আফগানিস্তান একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দেশটিতে একটি বিভক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আঞ্চলিক যোদ্ধাদের দ্বারা শাসিত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আফগানিস্তানে ১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া দশ বছর ব্যাপী সোভিয়েত ইউনিয়নের এক দুর্ভাগ্যজনক যুদ্ধে ১৪ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছিল। এত ক্ষয়ক্ষতির পরেও মস্কো সেখানে টিকতে পারেনি। বহু রাশিয়ান আফগানিস্তান থেকে পাওয়া ওই মানসিক ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আফগানিস্তানে মস্কোর পতন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। কিছু রাশিয়ানরা এখন দেজা-ভুর অনুভূতি অনুভব করছে, এবং বিপর্যয়কর ওই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছে।
বর্তমান পরিস্থিতি রাশিয়ার জন্য বহু স্তরে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। প্রথমত, আফগানিস্তান জঙ্গিদের উর্বর ভূমি হয়ে উঠেছে। ঠিক এ কারণে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে আফগান সীমান্তে যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে মস্কো। ইতিমধ্যে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের ঢল নেমেছে অন্যান্য দেশে। প্রতিবেশী তাজিকিস্তানে এমন অসংখ্য আফগান প্রবেশ করছে যাদের প্রকৃত পরিচয় যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না।
আফগানিস্তান থেকে পলায়নরতদের অনেকেই উজবেকিস্তান হয়ে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত উজবেকিস্তানে অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ অসংখ্য গোষ্ঠীর সশস্ত্র হামলার শিকার হয় সরকার। বর্তমানে দেশটি আস্তে আস্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। বর্তমানে দেশটি সন্ত্রাসবাদের যেকোনো উৎস নির্মূলে তৎপর। ঠিক এমন অবস্থায় আফগানিস্তান থেকে যাচাই ছাড়া শরণার্থী প্রবেশের বিষয়টি নিয়ে উজবেকিস্তান শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
মস্কোর আরেকটি উদ্বেগের জায়গা হলো মাদক পাচার। আফিমের অন্যতম বড় উৎপাদক হলো আফগানিস্তান। আফিমই তালেবানদের অর্থের প্রধান উৎস। যদিও তালেবানরা রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা মাদক নির্মূল করবে, তবে এ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থান নেওয়া তালেবানের পক্ষে সহজ হবে না।
তবে রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো তালেবান শাসনের অনিশ্চয়তা। আফগানিস্তানে পুতিনের কৌশল মস্কোর জন্য কূটনৈতিক বিজয় নিয়ে আসবে নাকি বিবর্ণ কোনো দৃশ্যপট রচনা করবে— তা বলার সময় এখনও আসেনি।
একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মধ্য এশিয়ায় অনুকূল ফলাফল নিশ্চিত করতে তার নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থার ব্যাপক কর্মযজ্ঞে জড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প পুতিনের হাতে নেই।
-নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ের বিশ্লেষণ
সারাবাংলা/আইই