Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় ঝুঁকিপূর্ণদের ভ্যাকসিন প্রয়োগের হারই সবচেয়ে কম

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৮ আগস্ট ২০২১ ১৫:০৪

ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণে শুরু থেকেই ঝুঁকিতে বেশি রয়েছেন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা। দেশেও এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যে ২৫ হাজার ৮৪৬ জন মারা গেছেন, তাদের অর্ধেকেরই বেশি ষাটোর্ধ্ব। সুনির্দিষ্টভাবে সংখ্যাটি ১৪ হাজার ৩৩২, যা মোট মৃত্যুর ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বয়স্কদের এই ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়েই দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগে শুরু থেকেই তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছে সরকার। অথচ এখন পর্যন্ত এই বয়সসীমার মাত্র ৩৯ শতাংশ মানুষ নিবন্ধন করেছেন সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে। এর মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন মাত্র ২০ শতাংশ ব্যক্তি। সে তুলনায় কম বয়সীদের মধ্যে ভ্যাকসিন নেওয়ার হার অনেক বেশি। এমনকি সম্প্রতি নিবন্ধনের সুযোগ পাওয়া অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সীদের ভ্যাকসিন নেওয়ার হারও ষাটোর্ধ্বদের তুলনায় বেশি।

বিজ্ঞাপন

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়ে মানুষদের মৃত্যুহার কমাতে হলে অবশ্যই সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় সবার আগে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে ভ্যাকসিন দিতে হবে ষাটোর্ধ্বদের। কারণ এই বয়সসীমার মানুষদের অন্যান্য রোগে আক্রান্ত থাকার হারও বেশি, ফলে মৃত্যুঝুঁকিও অন্যদের চেয়ে বেশি।

দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয় ২৭ জানুয়ারি। ওই দিনই ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহীদের নিবন্ধনের জন্য সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সহায়তায় ওয়েব প্ল্যাটফর্ম ‘সুরক্ষা’ চালু করা হয়। সেখানে নিবন্ধিতদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। সরকারের ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটি চারটি ধাপে দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিকল্পনা নেয়। সেই পরিকল্পনায় দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ের দুইটি ধাপেই অগ্রাধিকারভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা ছিল ষাটোর্ধ্বদের।

সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০২১ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব নাগরিকের সংখ্যা ১ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার ৩৬৯ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এই ষাটোর্ধ্ব নাগরিকের ৮০ শতাংশ হিসাব করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় এক কোটি ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৯৫ জনে। সরকারের খসড়া পরিকল্পনাতেও বিভিন্ন পর্যায়ে এই বয়সী এক কোটি ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৬৫৭ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলা হয়।

এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হলে খসড়া পরিকল্পনার পরিবর্তন এনে চল্লিশোর্ধ্বদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। ভ্যাকসিন সংকটের কারণে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে আবার ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। ৭ আগস্ট থেকে শুরু করা হয় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে গণটিকা কার্যক্রম। এক সপ্তাহ পর সেটি বন্ধ করা হলেও নিয়মিত ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে দেশে ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য বয়সসীমা ৪০ থেকে ধাপে ধাপে ২৫ বছরে নামিয়ে আনা হয়। একইসঙ্গে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের শিক্ষার্থীদেরও ভ্যাকসিন নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচিতে ষাটোর্ধ্বদেরই তুলনামূলকভাবে কম ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে এই বয়সের নাগরিকরা।

বিজ্ঞাপন

আইসিটি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য মোট নিবন্ধন হয়েছেন তিন কোটি ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫২৯ মানুষ। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সসীমায় নিবন্ধন করেছেন ৩০ লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৩ জন। আর ৭০ বছরের বেশি বয়সীদের নিবন্ধন হয়েছে ১৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮৪১। অর্থাৎ ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে নিবন্ধন করেছেন ৪৫ লাখ ৯৩ হাজার ৬৩৪ জন। অর্থাৎ মোট নিবন্ধনের মাত্র ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ষাটোর্ধ্ব।

অথচ ঠিক একই সময়ে সম্প্রতি নিবন্ধনের সুযোগ পাওয়া অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সীদেরই নিবন্ধন হয়েছে ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮০৭ জনের। এছাড়া ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের নিবন্ধন হয়েছে ৯১ লাখ ৮৬ হাজার ৯৯৩ জনের, ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সসীমায় নিবন্ধন করেছেন ৮২ লাখ ৬৮ হাজার ৬৮ জন। আর ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ৫৯ লাখ ৫৩ হাজার ২৭ জন নিবন্ধিত হয়েছেন সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে।

নিবন্ধন কেবল নয়, কোভিডে ঝুঁকিপূর্ণ ষাটোর্ধ্বদের ভ্যাকসিন নেওয়ার পরিমাণও বাকিদের তুলনায় কম। এখন পর্যন্ত যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ তিন হাজার ৩৭১ জনের বয়স ৪০ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১ লাখ ৪০ হাজার ৫৮৪ জন ভ্যাকসিন নিয়েছেন ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী। অথচ ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন মাত্র ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৬ জন। সত্তরোর্ধ্বদের মধ্যে এই পরিমাণ মাত্র সাত লাখ ১৬ হাজার ৭৭২ জন। অর্থাৎ দেশে ২৩ লাখ দুই হাজার ৬৫৮ জন ষাটোর্ধ্ব নাগরিক ভ্যাকসিন নিয়েছেন। ৫০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেও এই সংখ্যা ২৯ লাখ ৩৪ হাজার ৩৬০। আর সবশেষ সুযোগ পাওয়া অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়েছেন ১২ লাখ ছয় হাজার ৯৪৫ জন।

সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের এই হিসাব বলছে, দেশের ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের ৬১ শতাংশই এখনো নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছেন। অন্যদিকে ষাটোর্ধ্ব যারা ভ্যাকসিনের জন্য নিবন্ধন করেছেন, তাদেরও প্রায় অর্ধেক এখনো ভ্যাকসিন পাননি।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে হলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইনারদের পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে ষাটোর্ধ্বদের। প্রয়োজনে আলাদা বুথ স্থাপন করে বা আলাদা সেন্টারের মাধ্যমে তাদের ভ্যাকসিন প্রয়োগের আওতায় আনতে হবে। কারণ অপেক্ষাকৃত তরুণদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে ভ্যাকসিন নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না। আর যারা এখনো নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছেন, তাদেরও ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে তালিকা করে তাদের বাসায় গিয়ে হলেও নিবন্ধন ও ভ্যাকসিন প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে করোনায় মৃত্যুহার কমানো কঠিন হয়ে পড়বে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, যে তথ্য সামনে এসেছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে— আমরা ভ্যাকসিন প্রয়োগের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারিনি। এ কারণে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও স্বস্তি দিতে পারছি না।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে তিন কোটির বেশি মানুষ ভ্যাকসিন নিতে নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে এক কোটির বেশি মানুষকে আমরা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেছি। ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যদি আমরা ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের বেশি রাখতে পারতাম, সেটি সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কাজে আসত। কারণ বয়স ও অন্যান্য রোগের কারণে তাদের ষাটোর্ধ্বদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় বেশি। একইসঙ্গে তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।’

ডা. সায়েদুর রহমান খসরু আরও বলেন, ‘ষাটোর্ধ্বদের ভ্যাকসিন প্রয়োগের কারণে যে সুবিধা আমরা পেতাম, তা হলো মৃত্যুহার কমিয়ে সংক্রমণকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা। সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর গণটিকা কার্যক্রম চালাবে না। এখন টার্গেটেড পপুলেশনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করবে। এটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। যে পরিমাণ ভ্যাকসিন আসবে সেই হিসাবে যদি ষাটোর্ধ্বদের অগ্রাধিকার দিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, তাহলে হাসপাতালে ভর্তি কোভিড রোগীর সংখ্যাও কিন্তু কমে আসবে।’

‘ভ্যাকসিন দিলে সংক্রমণ কমবে না কিন্তু মৃত্যুঝুঁকি বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কমে আসবে। এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও স্বস্তি দেবে। একইসঙ্গে সবাই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে, বিশেষ করে মাস্ক পরাকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে সংক্রমণ থেকেও রক্ষা পেতে পারে’— যোগ করেন ডা. সায়েদুর খসরু।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, গণটিকা কার্যক্রমে তরুণদের উপস্থিতি ছিল বেশি। আর তাই ষাটোর্ধ্বদের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে এখন আর গণটিকা কার্যক্রম নেই। ষাটোর্ধ্বরা ভ্যাকসিন গ্রহণে কিছুটা পিছিয়ে আছে, এটি সত্যি। কিন্তু আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যেন তাদের প্রাধান্য দিয়েই সামনের দিনগুলোতে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা যায়।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

করোনা কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর