করোনায় মৃত্যু ছাড়াল ২৬ হাজার, শেষ ১০ দিনে হাজারের বেশি
৩০ আগস্ট ২০২১ ১০:১৫
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা গত সপ্তাহ দুয়েক হলো কমতির দিকে। একদিনে করোনায় মৃত্যু যেখানে আড়াইশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সেখানে এই সপ্তাহ দুয়েক সময়ের ব্যবধানে সেটি একশর নিচে নেমে এসেছে। তারপরও শেষ ১০ দিনে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন এক হাজার ১৩৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব বলছে, সব মিলিয়ে দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর ৫৪০ দিনে এই ভাইরাসের আক্রমণে মারা গেলেন হাজারের বেশি মানুষ।
রোববার (২৯ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ৮৯ জন। এ নিয়ে দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেলেন মোট ২৬ হাজার ১৫ জন।
যেভাবে করোনায় মৃত্যু ২৬ হাজারে
দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত বছরের ১৮ মার্চ। এক মাস পর ১৫ এপ্রিল করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০-এর ঘরে পৌঁছায়। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০১ জন। এক মাস পাঁচ দিন পর ২৫ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে যায়। এর ১৫ দিনের মাথায় ১০ জুন এই সংখ্যা স্পর্শ করে হাজারের ঘর। সে হিসাবে দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের ৯৫ দিনে করোনায় মৃত্যু স্পর্শ করে হাজারের ঘর।
এর ২৫ দিন পর ৫ জুলাই দুই হাজার ছাড়িয়ে যায় করোনায় মৃত্যু। এরপরের এক হাজার মৃত্যু হয় আরও দ্রুত— মাত্র ২৩ দিনে। ২৮ জুলাই তিন হাজারের ঘর ছাড়িয়ে যায় করোনায় মৃত্যু। দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে চার এবং পাঁচ হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে সময় লাগে ২৮ দিন করে। ২৫ আগস্ট চার হাজার ও ২২ সেপ্টেম্বর পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায় মৃত্যু।
এরপর করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর গতি সামান্য কমে যায়। ২২ সেপ্টেম্বরের ৪৩ দিন পর ৪ নভেম্বর ছয় হাজার, এর ৩৮ দিন পর ১২ ডিসেম্বর সাত হাজার এবং তার ৪২ দিন পর ২৩ জানুয়ারি করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু পেরিয়ে যায় আট হাজারের ঘর। এরপর মৃত্যু ৯ হাজারের ঘরে যেতে সময় লাগে ৬৭ দিন, এ বছরের ৩১ মার্চ দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার পেরিয়ে যায়। এরপর সংক্রমণ ভয়াবহ হয়ে উঠলে ২৫ এপ্রিলই করোনায় মোট মৃত্যু ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর ১৬ দিন পরে অর্থাৎ ১১ মে মৃত্যু ছাড়ায় ১২ হাজারের ঘর।
১১ জুন দেশে করোনায় মৃত্যু ১৩ হাজার ছাড়ায়। এর পরের হাজার মৃত্যুতে সময় লাগে ১৫ দিন। ২৬ জুন দেশে করোনায় মৃত্যু ১৪ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর ঠিক আট দিন পরেই ৪ জুলাই দেশে করোনায় মৃত্যু ১৫ হাজারে পৌঁছায়। এরপর ৪ থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ছয় দিনে দেশে এক হাজার ৯২ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
১০ থেকে ১৪ জুলাই, ১৫ থেকে ১৯ জুলাই, ২০ থেকে ২৪ জুলাই— এই সময়ের প্রতি পাঁচ দিনেই করোনায় মৃত্যু ছাড়িয়েছে এক হাজার করে। অর্থাৎ ১৪ জুলাই ১৭ হাজার, ১৯ জুলাই ১৮ হাজার ও ২৪ জুলাই করোনায় মৃত্যু ১৯ হাজার ছাড়ায়। এর চার দিনের মাথায় ২৮ জুলাইয়েই মোট মৃত্যু ২০ হাজারের ঘর অতিক্রম করে। এরপর ২ আগস্ট ২১ হাজার, ৬ আগস্ট ২২ হাজার ও ১০ আগস্ট করোনা সংক্রমণ নিয়ে মোট মৃত্যু ২৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
পরের ছয় দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান এক হাজার ২৭৮ জন। ১৫ আগস্ট দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়ায় ২৪ হাজার। তার ছয় দিন পরে অর্থাৎ ২০ আগস্ট কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
সবশেষ ১০ দিনে অর্থাৎ ২০ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন এক হাজার ১৩৭ জন। এর মাধ্যমে করোনায় মোট মৃত্যুসংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ২৬ হাজার।
করোনায় মৃতদের দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যুবরণকারী ৮৯ জনের ৪১ জন পুরুষ, ৪৮ জন নারী। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট ১৬ হাজার ৮৯৮ জন পুরুষ ও ৯ হাজার ১১৭ জন নারী করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন। শতাংশ হিসাবে করোনায় মোট মৃত ব্যক্তির ৬৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ, ৩৫ দশমিক ০৫ শতাংশ নারী।
বিভাগভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান
করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুতে বরাবরই এগিয়ে ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ। সার্বিক হিসাবেও এখনো মৃত্যুতে এগিয়ে এই দুই বিভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ঢাকা বিভাগে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ১১ হাজার ৩৭১ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ২০৪ জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগে মৃত্যুর পরিমাণ মোট মৃত্যুর ২০ শতাংশ। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৩৯৭ জন মারা গেছেন খুলনা বিভাগে, যা মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ০৬ শতাংশ।
এছাড়া রাজশাহী বিভাগে এক হাজার ৯২৮ জন (৭ দশমিক ৪১ শতাংশ), রংপুর বিভাগে এক হাজার ২৯৮ জন (৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ), সিলেট বিভাগে এক হাজার ১৩১ জন (৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ), বরিশাল বিভাগে ৮৯২ জন (৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ) ও ময়মনসিংহ বিভাগে মারা গেছেন ৭৯৪ জন (৩ দশমিক ০৫ শতাংশ)।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
দেশে সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা কমে এসেছে। একইসঙ্গে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও কমে এসেছে। তাই বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে— এমনটি ভাবার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণ, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ও করোনায় মৃত্যু কিছুটা কমে আসায় যদি আমরা অসতর্ক হয়ে পড়ি, তাহলে মাশুল গুনতে হবে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, করোনা রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুহার কমে আসায় স্বস্তির কিছু নেই। টানা দুই থেকে তিন সপ্তাহ করোনায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলেই কেবল ‘স্ট্যাবল ট্রান্সমিশন’ বলা যাবে। আর ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সংক্রমিত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি বা সংক্রমণে কেউ মৃত্যুবরণ করেননি— এমন অবস্থা যদি টানা দুই থেকে তিন সপ্তাহ ধরে রাখা যায়, তবেই বলা যাবে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে।
সংক্রমণের ধারা নিম্নমুখী থেকে ফের বাড়তে পারে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. রোবেদ আমিন বলছেন, করোনাভাইরাসের ‘আনপ্রেডিকটেবল’ বৈশিষ্ট্য ও নানা ধরনের ভ্যারিয়েন্টের কারণে এটি বলা কঠিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এরই মধ্যে করোনার সব ভ্যারিয়েন্ট দেখে ফেলেছে। এসব ভ্যারিয়েন্ট দীর্ঘ সময় থাকে না, দুর্বল হয়ে পড়ে। যে কারণে বর্তমান সময়ে আলফা, বিটা, গামা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।
অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, করোনার ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে ডেলটার যে বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন দেশে সেটি হলো— দুই থেকে তিন মাস ঝড়ের মতো প্রভাব থাকে। এরপর ধীরে ধীরে সেটি কমে যায়। হয়তো বাংলাদেশও সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে দেশে নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসবে কি না, সেটি বলার সুযোগ নেই। যেকোনো নতুন ভ্যারিয়েন্টের আসার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এ কারণেই আগের মতোই এখনো করোনা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করাটাতে অভ্যাসে পরিণত করার আহ্বান জানাচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেই প্রতিরোধের পদ্ধতি একটাই— স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলি, তাহলে যেকোনো ভ্যারিয়েন্ট আসুক না কেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম থাকবে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর