Friday 23 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বামী-স্ত্রীর মিলনে ব্রেক্সিট বাধা, গন্তব্য অজানা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৩১ আগস্ট ২০২১ ০৯:৪০ | আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২১ ১৭:২৫

দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক কোরিন জাইলস। পেশায় চিকিৎসক। বিয়ে করেছেন ব্রেট জাইলসকে। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। স্বাভাবিক নিয়মে একসঙ্গেই থাকার কথা তাদের। কিন্তু দু’জনে থাকছেন দুই কাউন্টিতে— একজন আরেকজনের থেকে ২৫ মাইল দূরত্বে। আপাতত কোরিনকে থাকতে হচ্ছে ডোনেগাল কাউন্টিতে, আর ব্রেট থাকছেন ডেরি কাউন্টিতে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কচ্ছেদের চুক্তি ব্রেক্সিটই মূলত এই দম্পতির মধ্যে এই দূরত্ব তৈরি করেছে। তাদের মিলনে যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রেক্সিট পরবর্তী যে অভিবাসন নীতি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এমন দূরত্ব তৈরি করা নীতিকে তাই ব্রিটিশ সংসদ সদস্যই বলছেন ব্রেক্সিটের ‘অসাংবিধানিক সীমান্ত’ নীতি। অমানবিক এই নীতির কারণেই ব্রেটের সঙ্গে থাকতে পারছেন না কোরিন, তাকে থাকতে হচ্ছে সার্বক্ষণিক এক উদ্বেগের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে তুলে ধরা হয়েছে কোরিন-ব্রেট দম্পতির কথা। তাতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা ও জরুরি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কোরিন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি বেকার। যে কারণে স্থায়ী কোনো বাসস্থান নেই তার। বলতে গেলে যাযাবর জীবনযাপন করছেন। আর অভিবাসনের মাধ্যমে স্বামী ব্রেটের কাছে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকছেন বলে আয়ারল্যান্ডে তার চাকরির মেয়াদ বাড়ার কোনো সুযোগও নেই বলেই মনে করছেন তিনি।

বর্তমান পরিস্থিতেতে কোরিন রয়েছেন নানামুখী দুর্ভোগের মধ্যে। অভিবাসন নীতির কারণে আট মাস হলো তিনি আটকে রয়েছেন আয়ারল্যান্ডে, যেতে পারছেন না নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে থাকা ব্রেটের কাছে। আর এই সময়ের মধ্যে তার আয়ারল্যান্ডের রেসিডেন্সি পারমিটের মেয়াদও শেষের দিকে। ফলে তাকে এখন নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরত যাওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। কেননা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ধরা পড়লে তাকে জোর করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে নিজ দেশে।

বিজ্ঞাপন

কোরিন-ব্রেট দম্পতির এই দুর্ভোগের পেছনে মূলত দায়ী ব্রেক্সিট। এই চুক্তির মাধ্যমে ইইউ থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে আসার পর অভিবাসন নীতিতে এসেছে পরিবর্তন। ওই সময় থেকে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের স্বামী-স্ত্রীর কেউ নন-ব্রিটিশ থেকে থাকলে তাদের ‘প্রি-সেটেলড স্ট্যাটাসে’র জন্য আবেদন করতে হচ্ছে। ভিসা ছাড়াই পরিবারের কাছে ফিরতে হলে সে আবেদন করার সুযোগ থাকছে আগামী বছরের ২৯ মার্চ পর্যন্ত। সেই আবেদনের পর তিনি যুক্তরাজ্যে প্রবেশের জন্য ইইউয়ের ‘ফ্যামিলি পারমিট’ পেলে তবেই পরিবারের কাছে ফিরতে পারবেন।

ব্রেক্সিট পূর্ববর্তী সময়ে এ ধরনের কোনো বাধা ছিল না। ওই সময় ব্রিটিশ কোনো নাগরিকের পরিবারের সদস্যদের কেউ নন-ব্রিটিশ তো বটেই, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের হলে যেকোনো সময় পরিবারের কাছে আসতে পারতেন। সেই সুযোগটি বন্ধ করে দিয়েছে ব্রেক্সিট।

এমন অভিবাসন নীতির বলিই হয়েছেন কোরিন-ব্রেট। দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫ বছর কাটানো এই জাইলম দম্পতি দুই বছর আগে আয়ারল্যান্ডে আসেন। লক্ষ্য ছিল যুক্তরাজ্যে ব্রেটের পরিবারের কাছে চলে আসবেন তারা। ওই সময় লেটারকেনি ইউনিভার্সিটি হসপিটালের দুর্ঘটনা ও জরুরি বিভাগে চাকরি নেন। আট মাস আগে যখন তারা আয়ারল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন, বিপত্তির শুরুটা তখন থেকেই। কোরিন-ব্রেট ওই সময় জানতে পারেন, কোরিনের জন্য যুক্তরাজ্যে প্রবেশের সুযোগ ছিল। তবে তার জন্য তাকে হোম অফিস থেকে ফ্যামিলি পারমিট পেতে হবে।

বিপত্তির শেষ এখানেই নয়। ব্রেট ওই সময় কাজ নেন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ডেরি কাউন্টিতে একটি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিংয়ের কাজ করতেন। সরকারি ওয়েবসাইট সূত্রে তিনি জানতে পারেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাধাহীনভাবে চলাচলের সুযোগ অক্ষুণ্ন রাখতে চাইলে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই যুক্তরাজ্যে ফিরতে হতো। ওই ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়, নন-ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের কোনো দেশের নাগরিককে বিয়ে করলে তার জন্য ফ্যামিলি পারমিট প্রয়োজন হবে। তার জন্য সামান্য কিছু টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে, সময় লাগবে মাত্র কয়েক সপ্তাহ।

সে অনুযায়ী আবেদন করেছিলেন কোরিন। কিন্তু পাঁচ মাস পরও তিনি সেই আবেদনের কোনো উত্তর পাননি। এমনকি হোম অফিস থেকে তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করা হয়নি। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বলা হয়েছে, আবেদনটি প্রক্রিয়াকরণের মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আবার কোরিন আয়ারল্যান্ড কিংবা যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতায় ভ্যাকসিনের জন্য আবেদনও করতে পারেননি।

কোরিন বলেন, আমি একেবারেই ভেঙে পড়েছি। বলা যায় শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছি। প্রতিটি ক্ষণ আমাকে উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। সারাদিনই আমার চোখ থাকে ইমেইলের দিকে, কখন আসবে সেই মেইল যার ওপর আমার ভাগ্য নির্ভর করছে।

হোম অফিস থেকে যোগাযোগ না করা বা কোনো কিছু না জানানোকে রীতিমতো মানসিক নির্যাতন বলে মনে করছেন কোরিন। তিনি বলেন, এর মধ্যে কিন্তু আমার বেকার জীবনের মেয়াদ বাড়ছে। ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলছে। কিন্তু হোম অফিসের পক্ষ থেকে আমাকে এভাবে অন্ধকারে রাখাটা চরম নির্যাতনের সমতুল্য। আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে ইউরোপে আসার দুই বছর পর এভাবে আমাকে দিনের পর দিন বেকার অবস্থায় সময় কাটাতে হবে, এরকম হতাশাজনক সময় কাটাতে হবে।

কোরিনের পরিবারের বাকি সদস্যরাও যুক্তরাজ্যে থাকেন। সেটি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার এখন একমাত্র চাওয়া একটি স্বাভাবিক জীবন। আমার মা, ভাই, বোন সবাই যুক্তরাজ্যে আছে। আমি একা কেবল সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এভাবে জীবন কাটানোটা দিন দিন আরও অসহ্য হয়ে পড়ছে।

ব্রেট যেখানে রয়েছেন, সেখানকার সংসদ সদস্য সোস্যাল ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড লেবার পার্টির কলাম ইস্টউড। তিনি নিজেও কোরিন-ব্রেট দম্পতির জন্য কাজ করেছেন। ইস্টউড বলেন, প্রতিবারই এই দম্পতি হোম অফিসের একগুয়েমির শিকার হয়েছে। নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে হোম অফিস কেন এমন আবেদনগুলোর নিষ্পত্তি করতে পারছে না— এমন প্রশ্নও এই সংসদ সদস্যের।

ব্রেক্সিট পরবর্তী এমন অমানবিক অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে কাজ করছেন লেবার পার্টির এমপি পিট কাইল। সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, সরকার একেবারেই ভুলে গেছে যে ব্রিটিশ নাগরিকদের সেবা করাই তাদের কাজ।

গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, কোরিন-ব্রেট দম্পতির মতো এমন আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে যারা এভাবেই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে একজন ব্রিটিশ নারী রয়েছেন, যিনি ফ্রান্স থেকে সাত বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে ফিরেছেন। কিন্তু তার ফ্রেঞ্চ স্বামী এখনো ‘ফ্যামিলি পারমিট’ পাননি। জার্মান একজন নারীও তার ব্রিটিশ স্বামীর কাছে ফিরতে ‘ফ্যামিলি পারমিটে’র জন্য অপেক্ষা করছেন সেই এপ্রিল মাস থেকে।

লেবার এমপি পিট কাইল বলেন, ব্রিটিশ নাগরিকদের এমন বৈরী ও হতবুদ্ধি করে দেওয়ার মতো আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি সরকারি নীতির কারণে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেই সমস্যা সমাধানের উপায় কী, সেটি জানার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। এটি চরমভাবে অসাংবিধানিক একটি চর্চা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গার্ডিয়ানের কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান হোম অফিসের একজন মুখপাত্র। তিনি শুধু বলেন, ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের যেসব সদস্য তাদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে ফিরছেন, তাদের ফ্যামিলি পারমিটের জন্য আবেদন করতে হবে। এরকম আবেদনের প্রতিটিই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবেদনের পরিমাণ ও জটিলতার কারণে সময় লেগে যেতে পারে।

পাঁচ মাস আগে জমা দেওয়া আবেদন এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওই মুখপাত্র জানান, হোম অফিস তাদের জনবলের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে যাবে।

সারাবাংলা/টিআর

অভিবাসন নীতি টপ নিউজ ব্রেক্সিট

বিজ্ঞাপন

জুনে বসছে বিপিও সামিট
২৩ মে ২০২৫ ০০:১৯

আরো

সম্পর্কিত খবর