তালিকায় আটকে ঢাবি শিক্ষার্থীদের সফট লোন, কাঠগড়ায় ‘প্রাসঙ্গিকতা’
৩১ আগস্ট ২০২১ ১৯:৫৫
দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোন কেনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দেওয়া সফট লোনের টাকা পেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখনো কোনো টাকা পাননি। এদিকে মহামারিকালীন বন্ধ শেষে আগামী অক্টোবর মাসে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এই ঋণ পেলেও সেটি কতটুকু প্রাসঙ্গিক হবে— এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
ইউজিসি সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো শিক্ষার্থীদের তালিকা অনুযায়ী টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে— কিছু শিক্ষার্থীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর সংক্রান্ত ভুলের কারণে প্রক্রিয়াটি শেষ করতে দেরি হচ্ছে। তবে চলতি সপ্তাহের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছাবে বলছে কর্তৃপক্ষ।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় অনলাইন পাঠদানে শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে গত বছরের নভেম্বর মাসে দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ হাজার ৫০১ জন অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে বিনা সুদে অনধিক ৮ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনের ভিত্তিতে প্রথম ধাপে ৮ হাজার ৫৫৯ জন শিক্ষার্থীর তালিকা ইউজিসিতে পাঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে ইউজিসি ফের আবেদনের আহ্বান জানালে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মোট ৬০৩ জন শিক্ষার্থী ঋণের জন্য অনুমোদন পান।
ইউজিসি থেকে টাকা এলেও শিক্ষার্থীদের ঋণ দিতে দেরি হচ্ছে কেন— এ বিষয়ে জানতে সফট লোন অনুমোদন কমিটির সদস্য-সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপহিসাব পরিচালক (লোন) মো. মশিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। কিছু শিক্ষার্থী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর সংক্রান্ত ভুল করেছিল। সেগুলো সংশোধন করতে সময় লেগেছে। আশা করছি, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে।’
এদিকে, রাজধানী শহরে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখনো এই সফট লোনের টাকা না পেলেও দেশের অন্য তিন স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাস কয়েক আগেই টাকা হাতে পেয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে ৪ হাজার ১০০ জন শিক্ষার্থী আবেদন করার পর ইউজিসি ফের আবেদন চাইলে শর্ত মেনে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৬৮৬ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেন। চলতি বছরের মার্চ মাসেই আবেদনকারী সবাই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মারফত টাকা পেয়ে যান।
এই ঋণের জন্য আবেদন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৪০৪ জন এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮২৫ জন শিক্ষার্থী এরই মধ্যে ঋণের টাকা বুঝে পেয়েছেন। ঋণ পেয়েছেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনকারী ৫৬৯ জন শিক্ষার্থীও। এ ক্ষেত্রে আবেদন করেও ঋণ এখনো পাননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ঢাবি শিক্ষার্থীরা বলছেন, গত দেড় বছরে অন্তত দু’টি সেমিস্টারের ক্লাস অনলাইনে সম্পন্ন করেছেন তারা। অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষাও নিয়েছে বেশ কয়েকটি বিভাগ। ক্লাস চলাকালীন, এমনকি পরীক্ষার আগেও ইউজিসির এই সফট লোন না পাওয়ায় হতাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রশ্ন— অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নির্বিঘ্ন করতে স্মার্টফোন কেনার জন্য সফট লোন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে টাকা বা স্মার্টফোন পেয়ে কী লাভ!
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জুনায়েদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ডিভাইস সমস্যার কারণে সফট লোনের আবেদন করেছিলাম। এর মধ্য কয়েকটি পরীক্ষা অনলাইনে হয়েছিল। অনেক কষ্টে সেগুলো কোনোরকমে পার করেছি নানা মানুষের সহায়তা নিয়ে। সামনে আবার অনলাইনে পরীক্ষা হতে পারে। ডিভাইসের কারণে পরীক্ষা দিতে পারব কি না, বলতে পারছি না। কারণ এখনো সফট লোনের খবর নেই। সময়মতো লোন না পেলে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আবেদন গৃহীত হয়ে কী হবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ক্লাস-পরীক্ষা সবই তো হয়ে গেল। অন্যজনের ফোন দিয়ে সামলাতে হয়েছে সব। ঋণের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু যে কারণে ঋণ, সেই কারণটাই তো আর রইল না। কষ্ট তো ঠিকই হলো আমাদের।’
এদিকে, অক্টোবর মাসে যদি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হয়, তবে সেক্ষেত্রে এতদিন পরে এসে স্মার্টফোন কেনার জন্য শিক্ষার্থীদের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি সন্দিহান, বিশ্ববিদ্যালয় আদৌ খুলবে কি না! তবে এই ঋণ দেওয়া নিয়ে আমরা অনেক দেরি করলাম। সত্যি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হলে এই ঋণ দেওয়াটা প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। ক্লাস, এমনকি পরীক্ষাও তো হয়ে গেছে অনেকগুলো বিভাগে। এ ছাড়া ক্লাস-পরীক্ষার জন্য স্মার্টফোন দেওয়ার পরিকল্পনাটাই অদ্ভুত। প্রয়োজন ছিল ল্যাপটপের ব্যবস্থা করা। এর মধ্যে আবার ৮ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার কথা শুনেছি। এই টাকায় উপযুক্ত স্মার্টফোন আদৌ কেনা সম্ভব?’
রাজধানী শহরের বাইরে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইউজিসির এই ঋণ পেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এখনো সেই ঋণ না পাওয়ার বিষয়টিকে ‘দুঃখজনক’ বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
তিনি বলেন, ‘এটি খুব দুঃখজনক। করোনার দুঃসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় মোবাইল ডাটা, স্মার্টফোন প্রভৃতি দিয়ে সহায়তা করা। বিশ্ববিদ্যালয় সে বিষয়ে কথাও দিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেটি পায়নি। বিভিন্ন খাতের মানুষ কিন্তু এই করোনায় প্রণোদনা পেয়েছে। শিক্ষার্থীদেরও এটি পাওনা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুই করা হয়নি। উল্টো ইউজিসি থেকে যখন ঋণ দেওয়ার কথা বলো, সেটি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পেলেও আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সেটির ব্যবস্থা করতে পারিনি।’
ঋণ প্রদানে দেরি করার বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে দেরিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলেও এই ঋণ প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
ঢাবি উপাচার্য সারাবাংলাকে বলেন, “ঋণ তো লাগবেই। এটি যখনই দেওয়া হোক, প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না কখনো। আর এই ঋণের টাকা তো আমার হাতে নেই। আমি যদি পারতাম, যেসব শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন, তাদের সহায়তা হিসেবে প্রথমেই দিয়ে দিতাম। এটাকে আর ‘সফট লোন’ বলতাম না। কত টাকাই বা প্রয়োজন ছিল!”
প্রসঙ্গত, ইউজিসি প্রদত্ত এই ঋণ শিক্ষার্থীরা চারটি কিস্তিতে অথবা এককালীন পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। তবে ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর নামে কোনো ট্রান্সস্ক্রিপ্ট ও সাময়িক বা মূল সনদ ইস্যু করা হবে না।
সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর
ইউজিসি’র লোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফট লোন স্মার্টফোনের জন্য ঋণ