আগস্টের শেষার্ধে সংক্রমণ কমে অর্ধেকে, মৃত্যু দুই-তৃতীয়াংশের কম
১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:২৯
ঢাকা: আগস্টেই একদিনে করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ সংক্রমণের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুও আগস্ট মাসেই দেখেছে বাংলাদেশ। তবে এই আগস্টের শেষার্ধে এসেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেমন কমতে শুরু করেছে, তেমনি কমছে করোনায় মৃত্যুর পরিমাণও। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, আগস্টের প্রথম ১৫ দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় এক লাখ ৬৯ হাজার ৪১৮ জনের মাঝে। তবে শেষ ১৬ দিনে সংক্রমণ শনাক্ত হয় মাত্র ৮১ হাজার ৭১৬ জনের শরীরে। অন্যদিকে আগস্টের প্রথম ১৫ দিনে যেখানে দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন তিন হাজার ৪৯০ জন, শেষ ১৬ দিনে এই সংখ্যা কমে হয়েছে দুই হাজার ২০।
মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো নিয়মিত বিজ্ঞপ্তির তথ্য বলছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ৮৬ জন। এই সময়ে ২৮ হাজার ৯৭টি নমুনা পরীক্ষা করে তিন হাজার ৩৫৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
এই তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত মোট ৮৯ লাখ ২৮ হাজার ৩৪৫টি নমুনা পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১৫ লাখ ৬১৮ জনের মাঝে। এর মধ্যে কোভিড সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ২৬ হাজার ১৯৫ জন।
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পরে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক হিসেবে আগের সব সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে গিয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই মাসে। এরপর আগস্টের শুরুতেও করোনা সংক্রমণ ও করোনায় মৃত্যুর গ্রাফ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে আগস্টের প্রথম দুই দিনে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। একইসঙ্গে এ মাসেই ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৯৮৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
আগস্টের প্রথম ১৫ দিনেই ভেঙে যায় অনেক রেকর্ড
আগস্টের প্রথম ১৫ দিনের মধ্যে ১১ দিনেই সংক্রমণ ছিল ১০ হাজারের বেশি। এই ১৫ দিনের মধ্যে দেশে দেখা যায় ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যাও। এই ১৫ দিনে দেশে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬২৭টি নমুনা পরীক্ষা করে এক লাখ ৬৯ হাজার ৪১৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। অন্যদিকে এই ১৫ দিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু হয় তিন হাজার ৪৯০ জনের। এর মাঝে ৫ আগস্ট ও ১০ আগস্ট দেশে ২৬৪ জন করে মৃত্যুবরণ করে যা দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ।
সংক্রমণ-মৃত্যু কমেছে আগস্টের শেষ ১৬ দিনে
আগস্টের প্রথম ১৫ দিনে করোনায় মৃত্যুর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও শেষ ১৬ দিনে এই হার কমে এসেছে। এ মাসের শেষ ১৬ দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন দুই হাজার ২০ জন। এর মাঝে আগস্টের শেষ চার দিন ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু নেমে এসেছে ১০০ জনের নিচে। অথচ প্রথম ১৫ দিনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু হয়েছিল তিন হাজার ৪৯০ জনের। সে হিসাবে শেষ ১৬ দিনের মৃত্যুর সংখ্যা প্রথম ১৫ দিনের ৫৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
আগস্টের শেষার্ধে করোনা সংক্রমণেও নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। এ মাসের প্রথম ১৫ দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় এক লাখ ৬৯ হাজার ৪১৮ জনের শরীরে। তবে শেষ ১৬ দিনে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে মাত্র ৮১ হাজার ৭১৬ জনের মাঝে। সে হিসাবে প্রথম ১৫ দিনের তুলনায় শেষ দিনে সংক্রমণ নেমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে, সুনির্দিষ্টভাবে এর পরিমাণ প্রথম ১৫ দিনের ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।
সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষার মাস আগস্ট
দেশে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা শুরু করা হয়। মার্চ মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পর ২০২০ সালে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল জুন মাসে— ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫৩০টি। এ বছরের মার্চে সেই রেকর্ড ভেঙে নমুনা পরীক্ষা হয় ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯টি। আর সদ্য চলে যাওয়া এপ্রিলে দেশে ৭ লাখ ৯৯ হাজার ১৪০টি নমুনা পরীক্ষা হয়, যা ছিল জুন মাসের আগে সর্বোচ্চ।
জুন মাসে দেশে ৬ লাখ ৬১ হাজার ৪১৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। জুলাই মাসে দেশে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। এ মাসে দেশে ১১ লাখ ৩১ হাজার ৯৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তবে আগস্ট মাসে দেশে নমুনা পরীক্ষা করা হয় ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫১টি, যা দেশে এক মাসে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা। বারবারই তারা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণের তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের ধারা নিম্নমুখী হলেও তারা সতর্ক থাকার কথা বলছেন। কেননা, অসতর্কতায় যেকোনো সময় করোনা সংক্রমণ ফের মাত্রা ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, উৎস ও উৎপত্তিস্থলগুলো বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। সরকার আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে কিছু ফল মিলেছে। বর্তমানে শনাক্তের হার কমে আসছে। আগস্ট মাসের শুরুর দিক বিবেচনা করলে বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। তবে এর কারণে শিথিল হওয়া যাবে না।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে সংক্রমণ একবারে কমে গেছে, তা বলা যাবে না। তবে এই পরিস্থিতিতে বলা যায়— আমাদের সামনের দিনগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে। মাস্ক পরার বিষয়ে জোর দিতে হবে। গণপরিবহনে যাত্রী পরিবহনের সময় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার বিষয়টির দেখতে হবে। একইসঙ্গে পিকনিক স্পট থেকে শুরু করে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত না করা গেলে এগুলো বন্ধ রাখাই শ্রেয়।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, গণমাধ্যমে খবর দেখছি, শনাক্তের হার কমছে। কিন্তু এতে রিল্যাক্স হওয়ার কিছু নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে— এ বিষয়টি সবার মাঝে ছড়ানো প্রয়োজন। কেন এটি মানতে হবে, সেটিও জনগণকে বোঝাতে হবে। তারপর প্রয়োজন হবে এসব নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না, তার কঠোর মনিটরিংয়ের। এগুলোর কোনো একটি জায়গায় শূন্যতা তৈরি হলে শনাক্তের হার কমার কোনো সুফল মিলবে না।
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের গুরুত্ব তুলে ধরে ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল আরও বলেন, আমরা বারবারই বলছি— স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিকল্প নেই। মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে, জনসমাগম করা যাবে না। এগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করলেই কিন্তু করোনার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ করা সক্ষম। তাই এ বিষয়গুলো নিয়ে অবহেলা করা যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু ও সংক্রমণ কমেছে বলে খুশি হওয়ার কিছু নেই। এটি আনপ্রেডিকটেবল ভাইরাস। নানা ধরনের ভ্যারিয়েন্ট এখনো আসছে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলেও জটিলতা রয়ে গেছে। তবে সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে কি না— এটি বলা খুব কঠিন। টানা দুই থেকে তিন সপ্তাহ করোনায় শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে না থাকলে পরিস্থিতিকে ‘স্ট্যাবল ট্রান্সমিশন’ বলা যাবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রায় সব ভ্যারিয়েন্ট দেখে ফেলেছে। এসব ভ্যারিয়েন্ট দীর্ঘ সময় থাকে না, দুর্বল হয়ে পড়ে। যে কারণে বর্তমান সময়ে আলফা, বেটা, গামা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের যে বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন দেশে, দুই থেকে তিন মাস ঝড়ের মতো প্রভাব থাকে, এরপর ধীরে ধীরে কমে যায়। হয়তো বাংলাদেশও সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে দেশে নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসবে কি না, সেটি বলার কোনো সুযোগ নেই।
অধ্যাপক রোবেদ আমিন আরও বলেন, যেকোনো ভ্যারিয়েন্টেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলি, তাহলে যেকোনো ভ্যারিয়েন্ট আসুক না কেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা কম থাকবে।
তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সংক্রমিত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি বা সংক্রমণে কেউ মৃত্যুবরণ করেননি— এমন অবস্থা যদি টানা দুই থেকে তিন সপ্তাহ ধরে রাখা যায়, তাহলেই কেবল বলা যাবে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর