খুনিদের চাকরি দেন জিয়া, এমপি বানান খালেদা: প্রধানমন্ত্রী
১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:২৫
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৫ আগস্টের (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড) খুনিদের জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। আর খালেদা জিয়া তার থেকে আরও একধাপ ওপরে গিয়ে জনগণের সংসদ, সেই সংসদে ভোটারবিহীন নির্বাচনে এমপি বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রশিদ-হুদাকে বসিয়েছিল, বিরোধী দলের নেতা পর্যন্ত বানিয়েছিল খুনি রশিদকে। প্রয়াত সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং জেল হত্যাকাণ্ডে খুনিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিলেন।
বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ সব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, চলতি জাতীয় সংসদের কুমিল্লা-৭ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পীকার বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আলী আশরাফের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। আলোচনা শেষে শোক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
এরপর অধ্যাপক আলী আশরাফসহ শোক প্রস্তাবে থাকা সব মৃত্যুবরণকারী বিশিষ্টজনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা শেষে তাদের রুহের মাগফেরাত ও শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য হাফেজ নুরুল ইসলাম মাদানী।
শোক প্রস্তাবের ওপর প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক, গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, তরিকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বিকল্পধারার মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এবং বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙা, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কাজী ফিরোজ রশীদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক আলী আশরাফের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বলেন, ‘বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন প্রয়াত সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ। একজন ব্যবসায়ী, কৃষি বিষয়ক অভিজ্ঞ, সেই সঙ্গে একজন জ্ঞানী লোক ছিলেন। তিনি অধ্যাপনাও করেছেন, ব্যবসা করেছেন, রাজনীতিবিদও ছিলেন। আমরা একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন অভিজ্ঞ সংসদ সদস্যকে হারালাম।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অধ্যাপক আলী আশরাফ যে এলাকা থেকে নির্বাচন করতেন, সেই চান্দিনা (কুমিল্লা) এলাকা। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি কর্নেল রশিদের বাড়ি। আর তার পাশেই খন্দকার মোশতাকের বাড়ি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে একটা নির্বাচন হয়। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থেকে সেই নির্বাচনটি করেছিলেন। সকল রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ভোটারবিহিন নির্বাচন- সারা বাংলাদেশে সেনাবাহিনী নামিয়ে দিয়ে, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে নির্বাচনটা করা হয়। সেই নির্বাচনে ওই চান্দিনা থেকে খুনি রশিদকে নির্বাচিত করে সংসদে নিয়ে আসেন এবং খালেদা জিয়া তাকে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসিয়েছে। আর চুয়াডাঙ্গা থেকে নির্বাচিত করেছিল আরেক খুনি মেজর হুদাকে।’
সংসদ নেতা বলেন, ‘১৫ আগস্টের খুনিদের জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি দিয়ে পুরষ্কৃত করেছিলো বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে। খালেদা জিয়া বোধ হয় তার থেকে আরও একধাপ ওপরে গিয়ে জনগণের এই সংসদ, সেই সংসদে একজন খুনিকে এনে বসায়।’
পরবর্তীতে ওই আসনে আবার আলী আশরাফ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। সব থেকে বড় কথা অধ্যাপক আলী আশরাফের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ১৯৭৫-এর পর, যখন আমি ১৯৮০ সালে লন্ডনে। এর পরবর্তীতে তিনি সব সময় ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন, আবার ৩ নভেম্বর যে জেল হত্যাকাণ্ড তার বিরোধিতা করেছেন, আর সেখানে তিনি সাক্ষীও দিয়েছেন খুনিদের বিরুদ্ধে।
প্রয়াত এ নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অধ্যাপক আলী আশরাফ সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি বিষয়ে ১৫টি বই লিখেছেন। এগুলো আগামী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন শীর্ষক একটা গবেষণামূলক বইও প্রকাশ করেছেন, যা আমাদের আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখবে, আর নবীন পার্লামেন্টরা যারা সংসদে সদস্য হয়ে আসবেন তারাও অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘অধ্যাপক আলী আশরাফ সাহেব অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল ভর্তি হওয়ার পর আমি প্রতিনিয়ত খবর নিয়েছি। আশা ছিলো বেঁচে ফিরে আসবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনেক চেষ্টা করেও তাকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। না ফেরার দেশেই তিনি চলে গেছেন। এই সংসদের অনেক সদস্যকে আমরা হারিয়েছি। এটা সত্যিই দুঃখজনক।’
বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, ‘চলতি সংসদে অনেক সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন, প্রতিটি অধিবেশনেই শোক প্রস্তাব আনতে হচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত অমায়িক ও সজ্জন মানুষ ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফ। অত্যন্ত কাজ পাগল, দক্ষ, বন্ধুবৎসল, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ এই পার্লামেন্টারিয়ানের মৃত্যু দেশের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি। অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন।’
সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘অত্যন্ত স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন অধ্যাপক আলী আশরাফ। অত্যন্ত জটিল ও বৈরী নির্বাচনী এলাকা থেকে সবাইকে সামলিয়ে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সফলভাবে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংকটে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। অতি সমালোচক ও বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও তার সম্পর্কে কখনও কোন কটু কথা বলতে পারেনি। তার মতো ধৈর্যশীল, কুশলী ও অভিজ্ঞ এই পার্লামেন্টারিয়ানের জায়গা কোনদিন পূরণ হবে না।’
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শিক নেতা ছিলেন অধ্যাপক আলী আশরাফ। বঙ্গবন্ধুর খুনী মোশতাক ও রশিদের বাড়ি ছিল কুমিল্লায়। অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু খুনিদের সঙ্গে কোন আপস করেনি। বৈরী অবস্থায় তাকে রাজনীতি করতে হয়েছে। অত্যন্ত জ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান অধ্যাপক আলী আশরাফ অন্যায়কে কোনোদিন প্রশ্রয় দেননি। সংসদেও তিনি যেটা বিশ্বাস করতেন, তা স্পষ্ট করে বলতেন। এমন সৎ, নিষ্ঠাবান নেতার মৃত্যু নেই।’
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক মরহুম অধ্যাপক আলী আশরাফের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, ‘তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের মীরজাফর-খুনি মোশতাকের সঙ্গে কুমিল্লার অনেক নেতা দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু অধ্যাপক আলী আশরাফ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে