Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আফগান অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে পারবে তালেবান?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:৪৫

আফগানিস্তানে এটিএম বুথের সামনে দীর্ঘ সারি

আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এখন তালেবান। শিগগিরই সরকার গঠনের ঘোষণাও দিয়ে রেখেছে সংগঠনটি। রাজধানী কাবুলের দখল নেওয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ দিন ধরে যুদ্ধ করে যাওয়া তালেবান দেখিয়েছে, দেশটির সরকার কতটা দুর্বল ছিল। তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর এ সপ্তাহেই দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা এখন পর্যন্ত তালেবানের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তবে সরকার ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা তালেবানের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেশটির ধ্বসে পড়া অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা।

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘ দিন ধরেই আফগানিস্তানের অর্থনীতি ভঙ্গুর। গত কয়েক দশকে দেশটি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ খরার মুখোমুখি হয়েছে। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তো ছিলই। ফলে তালেবান ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই অর্থনৈতিকভাবে কঠিন সময় পার করছে আফগানিস্তান।

চাল, আটা, তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আফগানিস্তানে আকাশছোঁয়া, যা দিন দিন আরও বাড়ছে। দেশটিতে পেট্রোলসহ জ্বালানির দামও অস্বাভাবিক। ফলে যাতায়াতের জন্য যাদের গাড়ির ওপর নির্ভর করতে হয়, তাদের অবস্থা সঙ্গীন। দেশটির ব্যাংকগুলোতেও লেনদেন সীমিত। গ্রাহকরা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি অর্থ উত্তোলন করতে পারে না। ফলে নগদ টাকার সংকটও রয়েছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির করে দিয়েছে।

আফগানিস্তানের একজন সরকারি কর্মকর্তা সাহাব সিদ্দিক (ছদ্মনাম) বলছেন, হেরাত সিটিতে ব্যাংক এখনো বন্ধ। গোটা শহরে মাত্র দুইটি এটিএম বুথ খোলা আছে, যেখান থেকে টাকা তুলতে গেলে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন বুথে ঢোকার সুযোগ পাবেন, তখন দেখবেন বুথের টাকা শেষ অথবা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বুথ বন্ধ।

এমন তীব্র অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই আফগানিস্তান থেকে লাখ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে যেমন উদ্বাস্তু হয়েছে, তেমনি ইরান অথবা পাকিস্তানের মতো সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ও নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক আফগান নাগরিকের কাছেই ব্যক্তিস্বাধীনতার চেয়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাই রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটানোর অন্যতম কারণ।

এ বিষয়টি ইঙ্গিত করেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হেরাত শহরের একজন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী প্রশ্ন রেখে বলেন, তালেবান কীভাবে অর্থ সংকটকে মোকাবিলা করবে? এক মার্কিন ডলারের দাম এখন ৮৬ আফগানিরও (আফগানিস্তানের মুদ্রা) বেশি। তালেবান ক্ষমতা দখলের আগেও এটা ছিল ৮০ আফগানি। দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

অর্থনৈতিক এই প্রবল ধাক্কার কারণ কী?
স্থানীয়রা বলছেন, আফগানিস্তানের অর্থনীতির অন্যতম নির্ভরতা ছিল বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুদান ও সহায়তা। এটি আবার আগের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতেই আসত। দেশটিতে মার্কিন আগ্রাসন শুরুর পর বৈদেশিক অনুদান ও উন্নয়ন সহায়তায় অর্থনীতি অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। গত বছর দেশটির জিডিপির ৪২ শতাংশই ছিল বিদেশি অনুদান ও সহায়তা। আফগানিস্তানের সরকারি ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশও এই খাত থেকে আসা অর্থ দিয়েই পরিচালিত হয়েছে। তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর সেই অনুদান কতটা আসবে, তা নিয়ে সন্দিহান সবাই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগানিস্তানে এই অনুদান ও সহায়তার পরিমাণ কমছিল। কারণ অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছিল প্রাইভেট কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে তালেবান ক্ষমতায় আসায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানি দেশটিতে অর্থায়নের যে পরিকল্পনা করেছিল, তা স্থগিত করে দিয়েছে। এখনো হয়তো এই দেশ ও সংস্থাগুলো মানবিক সহায়তা দিয়ে যাবে, তবে সেটি হবে দাতব্য সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। আফগান সরকারের কাছে সরাসরি আর্থিক অনুদান বা সহায়তা এদের কেউই দেবে না।

লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজ তাদের বিশ্লেষণে বলছে, অনুদান বা সহায়তা দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকলে আফগান সরকারকে ব্যাপক চাপের মুখে পড়তে হবে। সরকার খরচ করার মতো টাকা পাবে না। ফলে সরকারি কর্মী ছাঁটাই করতে হবে। এনজিওগুলোকেও ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো মৌলিক সেবাগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। মূল্যস্ফীতি চরম আকার ধারণ করবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে।

এখানেই দুরবস্থার শেষ নয়। কেননা আফগানিস্তানের প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ব্যবহার করতে পারবে না তালেবান সরকার। কারণ এই রিজার্ভের ৭ বিলিয়নেরও বেশি রয়েছে বিভিন্ন মার্কিন ব্যাংকে, যা ওয়াশিংটন এরই মধ্যে ‘ফ্রিজ’ ঘোষণা করেছে।

আফগানিস্তানে এ বছরও খরা দেখা গেছে। এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে ফসল উৎপাদনে। এ কারণে জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি সতর্কবার্তা দিয়েছে, বিপুলসংখ্যক আফগান নাগরিক তীব্র খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে।

তালেবানের জন্য আফগানিস্তানের এই অর্থনৈতিক সংকট কতটা চ্যালেঞ্জিং?
তালেবানের কাছে এটি স্পষ্ট, তাদের জন্য কার্যকরভাবে সরকার পরিচালনার অর্থ হচ্ছে নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ। পাশাপাশি জনগণকে ভবিষ্যতের আশাও দেখাতে হবে তালেবানকেই, যেখানে নাগরিকদের গড় বয়স ১৮ বছর।

ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত ঘটনাবলি তালেবানদের জন্য নিঃসন্দেহে অসামান্য সাফল্য। নিজেদের টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির সঙ্গেও তারা সম্পর্ক গড়ে তোলার ডাক দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে তালেবান বৈশ্বিক অর্থনীতির ধারায় যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে বিদেশি অনুদান ও উন্নয়ন সহায়তা পাওয়াও তালেবানের এই সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হওয়ার অন্যতম লক্ষ্য।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ ফুং সিউ বলেন, তালেবান এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন যে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগ তাদের থাকতেই হবে। তারা এ-ও জানে, আফগান অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে তাদের আন্তর্জাতিক অনুদান বা সহায়তার দরকার হবেই। কারণ একবার এই অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে, যা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা হয়তো তালেবানের থাকবে না।

এ কারণেই এখন পর্যন্ত কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংস্থাগুলোর বিষয়ে তালেবানের উন্মুক্ত থাকার ইঙ্গিত মিলেছে বলে মনে করেন সিউ। তিনি বলেন, ২০ বছর আগে তালেবানরা অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তাদের বিদেশি সহায়তা খুঁজতে হয়নি। এখন পরিস্থিতি তেমন নয়। তারপরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আফগানিস্তানে সহায়তা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে, তবে সেটি পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে কাতার থেকে। ফলে তালেবান সরকারে থাকলেও যে বিদেশি অনুদান বা সহায়তা আসবে না, বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথমত গোটা প্রক্রিয়াটি চালাতে হবে অত্যন্ত জটিল উপায়ে। দ্বিতীয়ত, এই প্রক্রিয়ায় তালেবান সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা সম্পৃক্ততা থাকবে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তালেবান সরকারের হাতে থাকবে না।

আফগানিস্তানের এই নাজুক অর্থনীতি তাই তালেবান সরকারের বড় একটি দুর্বলতা হয়ে দাঁড়াবে। আর সেটিকেই সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে পশ্চিমারা। রিজার্ভের অর্থ উত্তোলনের সুযোগ থেকে শুরু করে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি কিংবা জিহাদিদের উপস্থিতি অস্বীকার করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে তখন তালেবান সরকারকে চাপ প্রয়োগও করতে পারে এসব দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে এরকম দরকষাকষি আফগান জনগণের দুর্ভোগ কেবল আরও এক দফা বাড়িয়েই দেবে।

[আফগানিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্লেষণটি লিখেছেন মাইকেল সাফি ও আখতার মোহাম্মদ মাকই। প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত]

সারাবাংলা/টিআর

টপ নিউজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর