Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশে-বিদেশে সোহেল রানার সম্পত্তির পাহাড়!

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:১৪

ঢাকা: পুলিশের পরিদর্শক পদের একজন কর্মকর্তা সোহেল রানা। ছিলেন ডিএমপির বনানী থানায় তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি হয়ে গেছেন কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক। যার বেশির ভাগই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। বিদেশে গড়ে তুলেছেন বাড়ি, গাড়ি, হোটেল, রিসোর্ট ও অন্যান্য ব্যবসা। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের প্রতারণা ধরা পড়লে সোহেল রানা আলোচনায় আসে। অভিযোগ ওঠে, গ্রাহকদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা টাকার একটি বড় অংশ তিনি সরিয়ে ফেলেছেন।

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১০/১২ বছর ধরে ডিএমপিতে চাকরি করছেন সোহেল রানা। কখনো বনানী, কখনো গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা আবার কখনো ভাটারা ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় চাকরি করেছেন। সবসময় তিনি রাজনৈতিক উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একজন নেতার আশীর্বাদে অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। সবচেয়ে বেশি চাকরি করেছেন বনানী আর গুলশান থানায়। কখনো তার ওসি হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। একটু ছোট পদে থেকে ক্ষমতা বেশি খাটানো এবং নিজের জন্য বেশি সময় দেওয়া যায়- এই বিশ্বাসেই তিনি ই-অরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছিলেন। সেই প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রচুর সময় দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ই-অরেঞ্জের মাধ্যমে তিনি একাই প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তার আগেই তিনি দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পত্তি করেছেন। তদন্ত সংস্থার সদস্যরা বলছেন, অবৈধভাবে আয় করা অর্থ তিনি অবৈধভাবিই বিদেশে পাচার করেছেন।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, থাইল্যান্ডের পাতায়ায় হিলটন হোটেলের পাশে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। বাংলাদেশেও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে তার। এই অংকও প্রায় একশ কোটি টাকার কাছাকাছি। এছাড়া পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে সুপারশপ, বার ও রেস্টুরেন্টও রয়েছে সোহেল রানার।

তদন্ত রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, পূর্বাচলে ৩ নম্বর সেক্টরে প্লট ও নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে সোহেল রানার। একটি ফ্ল্যাটে তার ছোট খালু মো. সাগর থাকেন, অন্যটি ভাড়া দেওয়া আছে। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন তিনি। তার অফিস গুলশান-২ নম্বরে ডিসিসি মার্কেটের কাঁচাবাজারের পেছনে। এছাড়া গুলশানের শাহজাদপুরে আছে তার তিনটি ফ্ল্যাট। খাগড়াছড়িতে একটি রিসোর্টের জন্য জায়গা কেনা রয়েছে সোহেলের। গোপালগঞ্জে প্রায় ৫০০ বিঘারও বেশি জমির মালিক তিনি। এছাড়া তিনি বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে আমেরিকান, জার্মান ও কোরিয়ান ক্লাবের সদস্য হয়েছেন।

বিদেশে সম্পদের মধ্যে রয়েছে- থাইল্যান্ডের পাতায়ায় জমি, ফ্ল্যাট ও সুপারশপ। সেখানে হিলটন হোটেলের পাশে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে শতকোটি টাকার বিনিয়োগ, পর্তুগালে দোকান ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, প্যারিসে রেস্টুরেন্ট ও বার ব্যবসা, ফিলিপাইনের ম্যানিলায় স্ট্রিট বার এবং নেপালেও নানা ব্যবসায় তার বিনিয়োগ আছে। তার রয়েছে বিদেশি বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড।

গোয়েন্দা সংস্থাটি জানায়, পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল এখন পর্যন্ত চারটি বিয়ে করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় ১০ বছর হলো প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী একজন অভিনেত্রী। লন্ডনে উচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়ে তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন। আর চতুর্থ স্ত্রীর নাম নাজনীন নাহার বিথী। এই বিথীও অর্থ আত্মসাত মামলার একজন পলাতক আসামি। সোহেল সর্বশেষ শাহজাদপুরের সুবাস্ত নজরভ্যালির টাওয়ার-৩ এর ফ্ল্যাট ১০/বি-এ বসবাস করতেন।

আরও পড়ুন:

তদন্তে এখন পর্যন্ত দুটি বেসরকারি ব্যাংকে ই-অরেঞ্জের অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০ জুলাই পর্যন্ত একটি ব্যাংকের হিসাবে জমা পড়ে ৬২০ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার ৭২৯ টাকা। বিপরীতে মোট ৬২০ কোটি ৪৪ লাখ ৭১ হাজার ৯৯২ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ওই হিসাব নম্বরে এখন মাত্র ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৩৭ টাকা জমা আছে। আরেকটি ব্যাংক হিসাবে দেখা যায়, ৩০ জুন পর্যন্ত জমা পড়ে ৩৯১ কোটি ৬৭ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৯ টাকা। বিপরীতে তুলে নেওয়া হয়েছে বাকি ৩৮৮ কোটি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৫৯ টাকা। আর জমা আছে দুই কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৯ টাকা মাত্র।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ই-অরেঞ্জের টাকা আত্মসাৎ ছাড়াও সোহেল রানা ক্ষমতা খাটিয়ে বনানী ও গুলশান এলাকার স্পা সেন্টার, বিউটি পার্লার, আবাসিক হোটেল ও বারগুলো থেকে বিপুল অংকের চাঁদাবাজি করতেন। এমনকি কাস্টমার ও ব্যবসায়ীদের ধরে এনে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করতেন তিনি। ভুক্তভোগীরা প্রাণের ভয়ে অভিযোগ করতেন না। এভাবে সোহেল রানা টাকার কুমিরে পরিণত হন। তার যাতায়াত ছিল উঁচু তলার মানুষের সঙ্গে। থানার তদন্ত কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও মামলার কোনো কাজে ঠিক সময়ে কখনোই পাওয়া যেত না তাকে। টেবিলে ফাইল রেখে এলে নিজের সময় মতো এসে সই করতেন।

আরও জানা গেছে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে যারা গাড়ি কিনতেন, কোনোভাবে সেই লোনের কিস্তি দুই/চারটা বন্ধ হয়ে গেলে সেই গাড়ি তার লোকজন দিয়ে তুলে নিয়ে আসা হতো। এরপর ব্যাংকের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিতো। আবার কখনো গাড়িটিই বিক্রি করে দিতেন সোহেল। তার স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসাও রয়েছে। দুবাই থেকে স্বর্ণ এনে যারা বিক্রি করেন দেশে তাদের সিন্ডিকেটকে বড়ধরনের সহযোগিতা করে টাকা হাতিয়ে নিতেন সোহেল রানা। স্বর্ণ মাফিয়াদের সঙ্গে তার খুব খাতির রয়েছে।

সোহেল রানার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোহেল রানা এখন মামলার আসামি। ভারত ও বাংলাদেশে তার নামে মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। এখন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সদর দফতর চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

ই-অরেঞ্জ সোহেল রানা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর