Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৬০ বছরের অপেক্ষায় পাওয়া রাস্তা ১৫ দিনেই পুকুরে!

রানা আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:০৩

সিরাজগঞ্জ: পাঁচ যুগ বা ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কয়েক হাজার অবহেলিত মানুষ চলাচল করছিলেন গ্রামীণ একটি কাঁচা রাস্তায় দিয়ে। বৃষ্টিতে জুতা হাতে, কাদা মাড়িয়ে আর বন্যায় কোমর পানি বা নৌকাই ছিল তাদের অবলম্বন। বদলেছে একের পর সরকার, বদলেছে স্থানীয় প্রতিনিধিও। আশ্বাসের উপরে আশ্বাসে হারিয়ে গিয়েছিল বিশ্বাস। কিন্তু হঠাৎ-ই সেই বিশ্বাস ফিরল মানুষের মনে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ভাগ্য খোলে এলাকাবাসীর, যাদের মনে ছিল একটি পাকা রাস্তার স্বপ্ন। যে রাস্তার মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে এবং এগিয়ে যাবে এলাকাটি। এক সময় পাকা রাস্তার স্বপ্নও পূরণ হলো তাদের। কিন্তু নির্মাণের মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই রাস্তাটি ধসে গেল পুকুরে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু অসাধু কর্মকর্তা আর ঠিকাদারের যোগসাজশে নিম্নমানের কাজের কারণেই ভেস্তে গেছে গ্রামবাসীর স্বপ্ন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের ঘরগ্রাম পূর্বপাড়ার ওই রাস্তা নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮৫ লাখ টাকা।

বিজ্ঞাপন

নানান সময়ে নানান জায়গায় যুগের পর যুগ ধরণা দিয়ে মিলেছিল প্রতীক্ষিত রাস্তাটি। কিন্তু সেটাও নির্মাণ শেষ হতে না হতেই ১৫ দিনের মধ্যেই ধসে গেছে। পাকাকরণের আগে কাঁচা রাস্তা দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা হলেও চলছিল। কিন্তু এখন পাকা রাস্তা ভেঙে সেই যোগাযোগ ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পায়ে হাঁটা ছাড়া এখন কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সেই স্বপ্নের ফাঁকে উকি দিচ্ছে হতাশা। কিন্তু এতকিছুর পরেও দায় নিচ্ছেন না স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে অনিয়মের কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলী।

বিজ্ঞাপন

এলাকাবাসীদের অভিযোগ, অসংখ্য জায়গায় ধরণা দিয়ে মেলে রাস্তাটির অনুমোদন। কিন্তু রাস্তার কাজ শুরু হওয়ার পর পরই নিম্নমানের কাজের অভিযোগ ওঠে। এরপরে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকার পর ফের শুরু হলে খুব দ্রুত কাজ শেষ করেন ঠিকাদার। তখনও নিম্নমানের কাজ করেন তারা। ফলে ১৫ দিনের মধ্যেই রাস্তার কয়েক জায়গা ধসে পুকুরে পড়ে রাস্তাটি। এর মধ্যে এক জায়গায় প্রায় ৪০-৪৫ মিটার রাস্তা ভেঙে পুকুরে চলে গেছে। ওই রাস্তা কাঁচা থাকাবস্থায় ভ্যান ও অটোগাড়ি চলাচল করলেও এখন সাইকেল ছাড়া কোনো যান চলাচল করতে পারে না। এখন আবার সেই পায়ে হাঁটাই ভরসা। মানুষজন অসুস্থ হলেও ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এতে ক্ষোভ বিরাজ করছে এলাকাবাসীর মনে। এমনকি নিম্নমানের কাজ করেও ঠিকাদার পুরো বিল তুলে নিয়েছে বলে জানা গেছে। আর এ কারণে রাস্তাটি আর মেরামত হবে কি না- সেটা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।

তাড়াশ উপজেলা প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানা যায়, ৮৫ লাখেরও বেশি টাকা ব্যয় ধরে ১ হাজার ১৫০ মিটার রাস্তাটির কাজ পান তন্ময় এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ৫০ মিটার বাদ দিয়ে ১ হাজার ১০০ মিটার রাস্তার কাজ করে তন্ময় এন্টারপ্রাইজ। তখন এলজিইডি বাকি ৫০মিটার রাস্তা বাদ দিয়ে বিল পরিশোধ করে। ফলে গ্রামবাসীদের হারাতে হয় আরও ৫০ মিটার রাস্তা। জানা যায়, গত বছরের ১৫ মে কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩০ জুলাই রাস্তার কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজ শুরু করা হয় অনেক দেরিতে। ফলে তরিঘড়ি করে কোনোরকমে নিম্নমানের কাজ সম্পন্ন করা হয় ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে। এমনকি একই দিনে কাজ হস্তান্তর করে তুলে নেওয়া হয় শতভাগ বিলও।

সরেজমিনে দেখা যায়, নির্মাণের ১৫ দিন যেতে না যেতেই প্রায় ৫০ মিটার রাস্তার সিংহভাগ ধসে পুকুরে চলে গেছে। এমনকি সেই জায়গায় গাইডওয়াল দেওয়ার কথা থাকলেও নামে মাত্র কিছু খুঁটি দেওয়া হয়েছিল। এখন পানি চলে আসায় সেই জায়গাটিও সংস্কারও করতে পারছে না ঠিকাদার ও কর্তৃপক্ষ। ফলে তাদের এই অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি আরও বেশি প্রকাশ্যে চলে আসে। এখন বলছেন, বর্ষার পরে ঠিক করে দেওয়া হবে। কিন্তু এরই মধ্যে ভাঙতে শুরু করেছে রাস্তার আরও কয়েকটি অংশ। যা নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে এলাকাবাসীর মনে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের রাস্তাটির দায়িত্বরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী (এসডি) মো. আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাস্তাটির কাজের মান নিয়ে সমস্যা নেই। নতুন মাটির জন্য কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে।’ এ সময় গাইডওয়ালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে ৪০মিটার গাইডওয়াল না দিয়ে প্যালাসাইটিং করা হয়েছে।’ কিন্তু সেটিও নেই বললে তিনি আর কোনও কথা বলতে রাজি হননি। তবে বর্ষা শেষ হলে আবার কাজ করে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। তবে রাস্তার অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজের ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

এ ব্যাপারে তাড়াশ উপজেলা প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাস্তাটিতে নিম্নমানের সামগ্রী দেওয়ায় এবং কাজে কিছু অনিয়ম হওয়ায় আমরা মাঝখানে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে আবার কাজ শেষ করা হয়েছে। তবে ধসে পড়া জায়গা বর্ষা শেষে মেরামত করে দেওয়া হবে।’ গাইডওয়ালের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সেখানে নিয়ম অনুযায়ী গাইডওয়াল দেওয়া হয়েছে।’ এক্ষেত্রে উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেনের বক্তব্যের সঙ্গে তার বক্তব্যে অমিল পাওয়া যায়।

রাস্তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তন্ময় এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম এ আল বাকি বলেন, ‘যেহেতু বর্ষার মৌসুম, তাই রাস্তাটি ধসে গেছে। আমার জামানত এখনো আছে। তাই বর্ষার পরে আমি রাস্তাটি আবার সংস্কার করে দেবো।’ নিম্নমানের কাজের জন্য কিছুদিন না কি কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল?- এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তন্ময় এন্টারপ্রাইজকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এখন মাটি পাওয়া যাচ্ছে না তাই বর্ষার পরে রাস্তাটি ফের ঠিক করে দেওয়া হবে।

সারাবাংলা/পিটিএম

পুকুর সিরাজগঞ্জ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর