Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাপানি ‘জিম্মি বিচার ব্যবস্থা’র বলি ইমরান-নাকানোর ২ মেয়ে

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:২৩

ফাইল ছবি: আদালতে ২ শিশু

ঢাকা: বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান শরীফ আর জাপানি চিকিৎসক এরিকো নাকানো বিয়ে করেন ২০০৮ সালে, জাপানের আইন অনুযায়ী। এরপর তারা টোকিওতেই বাসবাস শুরু করেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে রয়েছে তিন কন্যা— জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)। তারা তিন জনই টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের শিক্ষার্থী।

কিন্তু ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরান এরিকোর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে ২১ জানুয়ারি শরীফ ইমরান আমেরিকান স্কুল ইন জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু এতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর একদিন জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা স্কুল বাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে ইমরান তাদের অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।

বিজ্ঞাপন

গত ২৫ জানুয়ারি শরীফ ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছ থেকে মেয়েদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মেয়েদের নিজ জিম্মায় পেতে আদেশ চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি মেয়েদের সঙ্গে এরিকোর সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে আদেশ দেন। কিন্তু ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়েকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে’ ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিয়ে তিনি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।

বিজ্ঞাপন

এরপর গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশে আসেন নাকানো এরিকো। পরে দুই মেয়েকে নিজের জিম্মায় পেতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। দুই শিশুকে কে ফেরত পাবেন? বাবা না কি মা? এসব বিষয় নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। জাপানি আইনে বাংলাদেশি পিতা ইমরান শরীফের কী হতোতা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ।

জানা যায়, জাপানি আইনে এই বিচার হলে কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই শিশু দুটিকে জাপানের ওই নাগরিকের হাতে তুলে দেওয়া হতো। অন্যদিকে বাংলাদেশি পিতা ইমরানের ভাগ্যে জুটত জেল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে জাপানের এই একতরফা নির্মম বিচার ব্যবস্থার নানান চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

জাপানের আদালত এই দুই শিশুর ক্ষেত্রেও মা এরিকোর পক্ষে রায় দিয়েছিল। এরপর বাবাকে জাপান থেকে বাধ্যতামূলক বের করে দেওয়া হয়। জাপানের পারিবারিক আদালত এরকমই বিচার করে থাকেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এদিকে, দুই শিশুর মা নাকানো বাংলাদেশে এসে হাইকোর্টে রিট করেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘দুই শিশুকে তার বাবা অপহরণ করে নিয়ে এসেছেন।’

কিন্তু দুই শিশুই আদালতকে জানায় মায়ের সঙ্গে নয়, তারা বাবার কাছে থাকতে চায়। তারা আরও জানায়, বাবা ইমরান তাদের চুরি করে নিয়ে আসেননি, বরং তারাই বাবাকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে। অথচ সিআইডির একটি টিম জাপানি দূতাবাসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাবাসহ দুই বাচ্চাকে গুলশানের বাসা থেকে তুলে আনে। এরপরই খোলসা হতে থাকে সবকিছু।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশি ইমরান নয়, ইউরোপ আমেরিকার হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে একই কাজ করেছে দেশটির আদালত। কোনো ভিনদেশি কেউ জাপানি নাগরিককে বিয়ে করে, কোনো কারণে তাদের যদি বনিবনা না হয় এবং সেটি যদি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, তাহলে জাপানের পারিবারিক আদালত মামলার রায় দেন তাদের নাগরিকের পক্ষে। আর তাদের যদি কোনো সন্তান থাকে, তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় জাপানি বাবা অথবা মায়ের হাতে। এরপর ভিনদেশি স্বামী বা স্ত্রী যদি নিজের সন্তানদের দেখতেও যান বা নিজের কাছেও নিতে চান, তখন ভিনদেশিদের নামে দেওয়া হয় শিশু অপহরণের মামলা। আর সেই মামলায় চোখ বন্ধ করে জিতে যায় জাপানি নাগরিক।

গত ৩১ আগস্ট বাংলাদেশের উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছিলেন, তা দেখে সবাই প্রশংসা করেছেন। যেকোনো ইস্যুতে যারা বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন তারা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সন্তানদের স্বার্থে বাবা-মা দু’জনকে একসঙ্গে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। বিচারক এরিকো ও ইমরান কাউকে সন্তানদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে চাননি। জাপানি আইন সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা বলছেন, এটি যদি জাপানের আদালত বিচার করলে সন্তানদের তুলে দেওয়া হতো এরিকোর হাতে। আর ইমরানকে অপহরণকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হতো।

রয়টার্সের সেই প্রতিবেদনে লেখা আছে, অনেক ভিনদেশির অভিযোগ, জাপানে এটিই চলে আসছে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে সন্তানদের জাপানি বাবা-মায়ের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আর বিদেশি যে বাবা বা মা তাদের সন্তানের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারেন না। আর জাপানের গণমাধ্যমও তাদের আইনের পক্ষে সাফাই গেয়ে এ ধরনের ঘটনায় ভিনদেশি নাগরিককে সন্তানের অপহরণকারী হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে।

রায়টার্সের এই প্রতিবেদন ছাড়াও এ বিষয়টি সম্প্রতি অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। জাপানিদের এরকম ‘প্রথা’র শিকার ইউরোপীয় পিতাদের নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি করা হয়েছে। সাবেক অটো এক্সিকিউটিভ কার্লোস গুশান এই সিস্টেমের নাম দিয়েছেন ‘হোস্টেজ জাস্টিস’ বা জিম্মি বিচার ব্যবস্থা। রয়টার্স ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার এসএমএইচ, বিবিসিসহ অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জাপানের এই জিম্মি বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

আরও পড়ুন:

এসব প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাপানের আদালতে ভিনদেশিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। ইমরানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এরিকো বাংলাদেশে এসেই ইমরানকে কিডন্যাপার ‍হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন। অথচ বাংলাদেশের আদালত বাচ্চাদের স্বার্থে বাবা-মাকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একসঙ্গে থাকার নির্দেশ দেয়। আদালত বলেন, তোমরা দু’জন নিজেরাই সমস্যা মিটিয়ে নিতে পার, যেন বাচ্চারা বাবা-মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত না হয়।

এদিকে, এরিকো নাকানোর ছোট বোন জাপানের স্থানীয় ফুজি টিভির সাবেক সংবাদপাঠক মিনাকু নাকানো তার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাসের তৃতীয় সচিব কিয়োহেই মিয়াজিকে ২ লাখ ৫০ হাজার ইয়েন অনলাইন ব্যাংকের মাধ্যমে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২ লাখ টাকার মতো। সচিব কিয়োহেই মিয়াজি ব্যাংক বিবরণ হলো— রাকুটেন ব্যাংক, শাখা নং-২২৮, মাম্বো, অ্যাকাউন্ট নম্বর ২৩৪৯৪১০। এই অর্থ নাকানো পরিবার থেকে পাওয়ার পর ‘ধন্যবাদ অর্থ’ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই টাকা জাপানের একজন জুনিয়র সরকারি কর্মকর্তাকে উৎকোচ বা ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার যুক্তিসঙ্গত একাধিক কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

ঢাকার জাপানি দূতাবাস থেকে মিয়াজি ও ইয়ামামোতো ঢাকার সিআইডি সদর দফতরে উপস্থিত ছিলেন। মিয়াজি এরিকো নাকানোর পক্ষ থেকে সবকিছু আয়োজন করেছিলেন। মিয়াজি প্রতিদিন এরিকো নাকানোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আসছেন। তিনি দূতাবাসের সব প্রটোকল পেরিয়ে এরিকো নাকানোকে সহযোগিতা করে আসছেন। এর পেছনে ওই টাকাও ভূমিকা রাখছে কি না কিংবা এর বাইরেও মিয়াজি আরও টাকা নিয়েছেন কি না, সেগুলো অনুসন্ধান করে দেখা উচিত বলে মনে করছেন অনেকে।

অন্যদিকে জাপানি নারী এরিকোর স্বামী ইমরান শরীফ যখন পিতৃত্বের দাবি বুঝে পেতে ছুটছেন আদালত থেকে আদালতে, ঠিক তখন আরও একজন বাংলাদেশি বাবা জাপানি নারীকে বিয়ে করার মাশুল গুনছেন। সৈয়দ মোস্তাক আহমেদ নামে ওই ব্যক্তি জাপানের জিম্মি বিচার ব্যবস্থার শিকার হয়ে নিজের একমাত্র মেয়েকে দেখতে না পারার কষ্টে পুড়ছেন।

মোস্তাক সারাবাংলাকে জানান, ২০১০ সালে তার সঙ্গে বিয়ে হয় জাপানি নারী তমুমি কুরিবার। তাদের ঘরে আসে এক কন্যা সন্তান। এরপর হঠাৎ-ই তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর মোস্তাকের শাশুরি ইচিকো কুরিবারা জাপানি ১০০ মাঙ্ক অর্থাৎ বাংলাদেশি ১১ লাখ টাকা দাবি করেন। হুমকি দেন, টাকা না দিলে তোমার সন্তানকে মেরে ফেলবেন।

সৈয়দ মোস্তাক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন টাকা দিই তখন ভালো। টাকা না পেলেই হুমকি দিতে শুরু করে। সন্তানকে দেখতে যাওয়ার কারণে কিডন্যাপের মামলায় অনেকবার জাপানি কারাগারে যেতে হয়েছে। এরপরও পাঁচ হাজার ইয়েন (জাপানি মুদ্রা) করে দিয়ে মেয়েকে দেখতে হতো।’

জাপানের কারাগার অমানবিক উল্লেখ করে মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘জেলখানায় আমার ব্রেন স্টোক হলো। কর্তৃপক্ষ আমাকে হাসপাতালে না নিয়ে ৯ তলা থেকে নিচতলায় নামিয়ে হাতে পায়ে রশি বেঁধে প্লায়ার্স দিয়ে নখে টানাটানি শুরু করে। এভাবে তারা দেখে আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি। জেল থেকে বের হলে অবৈধ অভিবাসন আইনের ফাঁদে ফেলে অমানবিকভাবে জাপান থেকে বের করে দিয়ে নিজের দেশে ফিরতে বাধ্য করেছে জাপান সরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডিভোর্সের পর গত ১১ বছর ধরে একাই আছি। বিয়ে করিনি। আশায় বুক বেঁধে আছি আমার মেয়ে যদি কোনোদিন ফিরে আসে। সবশেষ মেয়েকে দেখতে চেয়ে বাংলাদেশ থেকে জাপানি সাবেক স্ত্রীর কাছে চিঠি দিই। উত্তরে তমুমি (স্ত্রী) লিখেছে, দেখা করার চেষ্টা করলে কেটে টুকরো টুকরো করে কাবাব বানাব।’

এই অবস্থার সমাধান চান মোস্তাক আহমেদ। বিশ্বের সব বাবা স্মৃতি আগলে নয়, বরং বুকের কাছে যেন সন্তানদের পান— সেটিই প্রত্যাশা তার।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

ইমরান-নাকানো জাপানি ২ শিশু জিম্মি বিচার ব্যবস্থা জেসমিন মালিকা লাইলা লিনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর