Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৫৪৩ দিন পর বাজলো ঘণ্টা, প্রাণ ফিরেছে স্কুল-কলেজে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:১৬

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন সেঁজুতি দাশ। করোনাকালের মধ্যেই এসএসসি শেষে গত বছরের আগস্টে এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয় বাংলাদেশ মহিলা সমিতি কলেজে। কিন্তু ভর্তির পর একদিনও যেতে পারেনি কলেজে। আক্ষেপ নিয়ে একবছরেরও বেশি সময় ধরে বাসাবন্দি সেঁজুতি প্রথমবার কলেজের করিডোরে পা দিয়েছে।

এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস তার মধ্যে। স্কুলের সেই চিরচেনা বান্ধবীদের মধ্যে তেমন কেউ নেই। নতুন, নতুন সহপাঠী। প্রথম পরিচয়, ভাব বিনিময়- সব মিলিয়ে সেঁজুতির জন্য রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) ছিল অন্যরকম দিন।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ৫৪৩ দিন পর রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) থেকে আবারও ঘণ্টা বেজেছে স্কুল-কলেজে। দেড় বছরেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর খোলার
প্রথমদিনে কেমন ছিল চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজগুলোর পরিবেশ?

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, এ যেন এক উৎসবের আমেজ! প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর প্রতিষ্ঠানগুলোর আঙিনা। প্রথমদিনে সব শ্রেণির শিক্ষার্থী না থাকলেও যারা ছিলেন তাদের মধ্যে হইহুল্লোড়, কোলাহল, যেন প্রথমদিন স্কুলে যাবার আনন্দ ছুঁয়েছে তাদের।

মহিলা সমিতি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেঁজুতি দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্লাসে আমার আগের সহপাঠী শুধু একজনই আছেন। বাকি ৫০-৬০ জন সবাই নতুন। সবার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। শিক্ষকদের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। কলেজ জীবনের প্রথমদিন। খুব ভালো লেগেছে। কেমিস্ট্রি আর বাংলা ক্লাস হয়েছে। টিচাররা প্রথমদিন খুব সিরিয়াসলি ক্লাস নিয়েছেন।’

বিজ্ঞাপন

ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী অমৃতা সেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন স্কুলে আসা একধরনের অভ্যাস ছিল। প্রায় পুরো দুইটা ক্লাসের সময় স্কুলে না এসে বাসায় বসে কাটিয়ে দিতে হয়েছে। যেমন
নবম শ্রেণিটা তো আমরা আর ফেরত পাব না। দশম শ্রেণির সময়ও তো প্রায় শেষ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- দেড়টা বছর স্কুলে আসতে পারিনি। বাসায় অনেকটা বন্দি হয়ে ছিলাম। অনলাইন ক্লাসে তো আর সেভাবে স্কুলের আমেজ পাইনি। সেজন্য স্কুলে
আসতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে। অনেকদিন পর বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হল। তবে একটা শঙ্কা কাজ করছে যে, যদি আবারও সংক্রমণ শুরু হয় তাহলে কি আবারও স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে? আবারও কি আমাদের ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে?’

জামালখানের ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আবরার মোহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্কুলে এসে খুব ভাল লেগেছে। অনেকদিন পর আজ বন্ধুদের সাথে খুব খেলতে ইচ্ছে করছে। টিচারদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। উনারা আমাদের গোলাপ ফুল দিয়েছেন।’

দীর্ঘসময় স্কুল-কলেজবিমুখ থাকতে বাধ্য হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়ামুখী করতে নানা আনন্দ-আয়োজন করা হয়। এছাড়া মুখে মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যবস্থা করা হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ এবং জেলার প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি ও পাঠদানসহ সার্বিক পরিবেশ পরিদর্শন করেন।

ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীকে ফটকে লাল গোলাপ দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। প্রধান শিক্ষক বদরুন নেসা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দুই শিফটের স্কুল। দুই শিফটেই শিক্ষার্থীদের ঢোকার সময় ফুল দিয়েছি। দীর্ঘদিন পর স্কুলে এসেছে, তাদের সঙ্গে আমাদের যেন একটা ভালো বন্ডিং তৈরি হয়, তাদের মনটা যেন প্রফুল্ল থাকে, সেজন্য দিয়েছি। স্কুলে প্রবেশের আগে তাপমাত্রা মাপা হয়েছে। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে এবং স্যানিটাইজ করে প্রত্যেককে ক্লাসে ঢুকতে
দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের নির্দেশনা মেনে জেড-আকৃতিতে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বসানো হয়েছে। অর্থাৎ একটি বেঞ্চে একজন আর এর বিপরীত কর্নারে আরেকজন।’

নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রোববার তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস প্রতিদিন হবে। আর এর সঙ্গে প্রতিদিন অন্য একটি করে শ্রেণির পাঠদান হবে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম সারাবাংলাকে, ‘প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তো একেবারে কোমলমতি শিশু। তাদের মধ্যে আবার পড়ালেখার আগ্রহটা ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছি। তাদের আদর দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে লেখাপড়ামুখী করতে হবে। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকাটা। এটা সর্বোচ্চভাবে নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ফটকে গান, আবৃত্তি, ছড়ায় শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানো হয়। স্কুলটির সিনিয়র শিক্ষক শরণ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই শিফটে ৩২০ জনের মতো শিক্ষার্থী আজ (রোববার) স্কুলে এসেছে। আমরা প্রথমে
তাদের গোলাপ ফুল দিয়ে বরণের ব্যবস্থা করেছিলাম। কয়েকজনকে দেওয়ার পর দেখলাম, স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তখন আমরা উদ্বোধনী সঙ্গীত, আবৃত্তি ও ছড়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানিয়েছি। একটা
আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের যাতে পড়ালেখামুখী করা যায়, সেই চেষ্টা করা করছি।’

মোমিন রোডে কদম মোবারক সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথমদিন সেভাবে পাঠদান হয়নি। ক্লাসে গান, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, কৌতুকসহ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন করা হয়। স্কুলের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক দীপক দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছেলেরা অনেকদিন স্কুলে আসেনি। আমরা অনলাইনে যেসব ক্লাস নিয়েছি, সেগুলোতে তো অরিজিনাল ক্লাসে পাঠদানের যে অনুভূতি সেটা তারা পায়নি। দীর্ঘসময় স্কুলে না আসার কারণে তাদের অনেকের মধ্যে লেখাপড়া নিয়ে অনীহাও আসতে পারে। সেজন্য আমরা শুরু থেকেই তাদের ওপর পড়ার চাপ দিতে চাচ্ছি না। গান-আবৃত্তির মাধ্যমে পরিবেশটাকে সহজ করে তাদের পড়ালেখায় মনযোগী করতে চাই।’

নির্দেশনা অনুযায়ী, উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে রোববার দশম শ্রেণি, চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং সপ্তম শ্রেণির পাঠদান হয়েছে। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ফটক সাজানো হয়েছে রঙ-বেরঙের বেলুন দিয়ে। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের রসায়ন বিভাগের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে ২০ লিটার স্যানিটাইজার। রসায়ন বিভাগের প্রভাষক কিরিটি দত্ত সারাবাংলাকে বলেন,
‘ক্লাসগুলো স্যানিটাইজ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের গেট দিয়ে ঢোকার সময় হাত স্যানিটাইজ করা হয়েছে। তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। একটি বেঞ্চে দু’জন করে শিক্ষার্থী বসানো হয়েছে।’

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব মো. আব্দুল আলীম রোববার সকালে সিটি কলেজ পরিদর্শনে যান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুরো কলেজ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। এইচএসসি প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুসারে অনার্স ও মাস্টার্সের ক্লাসও চলছে। সার্বিক পরিবেশ ভালো দেখেছি।’

তবে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব না মানার প্রবণতা দেখা গেছে নগরীর কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন স্কুল এন্ড কলেজে। সেখানে ছাত্রীদের প্রবেশ করতে দেখা গেছে জটলার মধ্য দিয়ে। গেইটে শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাউকে দেখা যায়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির নিচতলায় চারটি রুমে জমে আছে ময়লা পানি। চারদিকে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। এ বিষয়ে স্কুল ও কলেজের দায়িত্বশীল কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

সকালে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন স্কুল এন্ড কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হওয়ার চিত্র দেখতে পান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি কলেজিয়েট স্কুলে প্রথমে গেলাম। সেখানকার পরিবেশ খুব ফাইন। মহসীন স্কুল ও সিটি কলেজের সামনে যানজট আছে। এজন্য ছাত্রছাত্রীদের জটলা তৈরি হয়। আমি পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে বিষয়টি জানিয়েছি। তবে কাপাসগোলা স্কুলে ছাত্রীদের দলে দলে কোনো ধরনের সামাজিক দূরত্ব না মেনে প্রবেশ করতে দেখেছি। হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা থাকলেও সেটা কেউ মনিটর করছেন না। বিষয়টি সিটি করপোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মুহাম্মদ মাহমুদউল্লাহ মারুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে আমাদের টিম স্কুল-কলেজের অভ্যন্তরে গিয়ে চমৎকার পরিবেশ দেখেছেন। হাতেগোণা দু’য়েকটি
ছাড়া সবগুলোতেই সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। তবে আমরা সমস্যা পেয়েছি অভিভাবকদের জটলা নিয়ে। অনেক স্কুলের সামনে অভিভাবকরা জড়ো হয়ে বসে আছেন। তাদের মধ্যে কোনো সামাজিক দূরত্ব নেই। আমরা অভিভাবকদের বুঝিয়েছি যে, আপনারা সন্তানদের পৌঁছে দিয়ে স্কুলের সামনে বসে থাকবেন না।’

জেলা প্রশাসনের হিসেবে, চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে ৩ হাজার ৭৪৮টি স্কুল আছে। এর মধ্যে মহানগরের ২১৫টি সহ জেলায় মোট ২ হাজার ২৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।

সারাবাংলা/আরডি/এএম

চট্টগ্রাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর