এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৪৯ ‘গায়েবি’ মামলা, নেপথ্যে ‘এক পীর’
১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:৪৭
ঢাকা: রাজধানীর শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী একরামুল আহসান কাঞ্চনের (৫৫) বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এসব ভুয়া মামলার নেপথ্যে এক পীর ও তার অনুসারীদের জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রতিবেদনে।
সিআইডির পক্ষ থেকে হাইকোর্টে ওই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির নেপথ্যে পীরের কারসাজির তথ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সেইসঙ্গে এ বিষয়ে শুনানি এক সপ্তাহের জন্য মুলতবি করা হয়েছে।
আদালতে এদিন রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এমাদুল হক বসির। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার ও অরবিন্দ কুমার রায়।
এর আগে, গত সপ্তাহে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দেন সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রতন কৃঞ্চ নাথ। খুন, ধর্ষণ ও মানবপাচারের অভিযোগে করা এসব মামলা সংক্রান্ত সিআইডি’র প্রতিবেদন দেখে রোববার হাইকোর্ট বলেন, ‘বাংলাদেশের পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন! জায়গা জমি দখলের জন্য পীর সাহেবরা অনুসারী-মুরিদ দিয়ে কী করে দেখেন! যেখানে একজন মানুষকে একটা মামলা দিলেই জীবন শেষ হয়ে যায়, সেখানে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এত মামলা! এটাতো সিরিয়াস ব্যাপার।’
রিটের শুনানিতে আইনজীবী ওয়াজি উল্লাহ বলেন, ‘২০ নম্বর বিবাদীর (আফজাল হোসেন) পক্ষে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। হাইকোর্টের আদেশ ৫ সেপ্টেম্বর স্থগিত করা হয়।’
আদালত বলেন, ‘তাহলে কি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না? তদন্ত স্থগিত করলে তদন্তও করা যাবে না?’ ওয়াজি উল্লাহ বলেন, ‘যাবে।’
এ সময় আইনজীবী এমাদুল হক বশির বলেন, ‘৪৯টি মামলা হলেও ২০টি মামলা নিয়ে রিট। ২০টি মামলার পাঁচজন বাদী আপিল বিভাগে পৃথক আবেদন করেন। তাদের মামলার ক্ষেত্র হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়েছে শুনেছি। তবে কপি পাইনি।’
তখন আদালত বলেন, ‘কপি নিয়ে আসেন। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেন। আপিল বিভাগের আদেশ নিয়ে আসেন। এই সপ্তাহের জন্য বিষয়টি মুলতবি রাখা হলো।’
সিআইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এবং এক বোন। ১৯৯৫ সালে তার বাবা ডা. আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার শরিফের পিছনে তিন শতাংশ জমির ওপর তিন তলা পৈতৃক বাড়ি তাদের। বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তর-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু রিট আবেদনকারী ও তার অপর ভাই ডা. কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেও ওই পীরের মুরিদ করা যায়নি। এর মধ্যেই একরামুল আহসান কাঞ্চনের মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির অধিকাংশই পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আর একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তার ভাইয়ের অংশটুকু পীর এবং তার দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য পীর দিল্লুর এবং তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের সঙ্গে একরামুল আহসান কাঞ্চনের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। সে শত্রুতার কারণেই একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়।’
সিআইডি’র এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সর্বমোট ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে জিআর মামলা ২৩টি এবং সিআর মামলা ২৬টি। ইতোমধ্যে জিআর ১৫টি মামলা এবং সিআর ২০টি মামলায় আবেদনকারী আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। যার মধ্যে আটটি জিআর এবং ছয়টি সিআর মামলা রয়েছে।
অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, হত্যার চেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলো সম্পর্কে প্রকাশ্য ও গোপনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী, ভুক্তভোগীরা কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং ওই দরবারের পীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এর আগে, দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৯টি মামলা হওয়ার প্রেক্ষাপটে একরামুল আহসান কাঞ্চন ২০টি মামলার ক্ষেত্রে তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। সেই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) একরামুলের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে রুলসহ আদেশ দেন। এরপর মামলাকারীদের কয়েকজন হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ পাঁচ মামলার ক্ষেত্রে স্থগিত করেন আপিল বিভাগ।
রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিপি, অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক (এসবি), অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক (সিআিইড), র্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকার পুলিশ কমিশনারসহ ৪০ জনকে বিবাদী করা হয়েছে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম