Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাটির সুর সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের প্রস্থানের এক যুগ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:৩১

সুনামগঞ্জ: ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্য ছিল সঙ্গী। এর মধ্যেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন একতারা। পেয়েছিলেন কমর উদ্দিন, রশিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহিম মোস্তান বকসের মতো গুরুদের সান্নিধ্য। গুরুর প্রতি নিবেদন আর হাওড়-বাওড়ের জল-হাওয়া সেই একতারায় ঢেলে দেয় সুরের ধারা। ভাটির সেই সুরে মিশে গিয়েছে সহজ জীবনবোধ। উজানধল পেরিয়ে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ে সারাবাংলায়। পৃথিবীর নিয়মে আব্দুল করিম দেহ রাখলেও তার সুর দিয়েই অমর হয়ে রয়েছেন বাঙালির কাছে।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের সেই বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ রোববার (১২ সেপ্টেম্বর)। অসংখ্য জনপ্রিয় বাউল গান ও গণসংগীতের এই রচয়িতা ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। দেহত্যাগের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জই শুধু নয়, গোটা দেশের মানুষের মুখে মুখেই এখনো ফিরছে তার লেখা, সুর করা সব গান।

১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজান দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেন শাহ আব্দুল করিম। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবন শুরু হলেও ছোটবেলা থেকেই সংগীতের সাধনা শুরু তার। একতারাও তার সঙ্গী তখন থেকেই। সুরের নেশাতেই কেটেছে বাকিটা জীবন। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হলেও কখনো গানকে ছাড়েননি তিনি। তার লেখা সহজ-সরল জীবনবোধের গানের বাণীর মতো তার জীবনও ছিল সাদামাটা।

বাংলার লোকজ সংগীতের ধারাকে আত্মস্থ করেছিলেন শাহ আব্দুল করিম। ভাটি এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ তুলে এনেছেন গানে। নারী-পুরুষের মনের কথা প্রকাশ করেছেন গানের বাণীতে। পাশাপাশি ছিল সমাজের অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব অবস্থান। আর স্রষ্টার প্রতি নিবেদনও ফিরে ফিরে এসেছে তার গানে। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তার গান প্রেরণা জুগিয়েছে।

শাহ আব্দুল করিমের গানের অনুপ্রেরণা ছিলেন ফকির লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ ও দুদ্দু শাহ। তাদের গান, তাদের সহজিয়া দর্শনই গড়ে তুলেছে আব্দুল করিমকে। তাদের মতোই তিনি সহজ-সরল জীবনযাপন করে গেছেন। তবে অন্যায়-অনিয়ম আর ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সরব ছিল তার কণ্ঠ। যে কারণে মৌলবাদীদের লাঞ্ছনাও সহ্য করতে হয়েছে তাকে।

শাহ আব্দুল করিমের লেখা ও সুর করা গানের সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি। সাতটি বইয়ে গ্রন্থিত আছে এসব গান। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। পেয়েছেন একুশে পদক। শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘ভাটির পুরুষ’ নামে প্রামাণ্য চিত্র। সুবচন নাট্য সংসদ আব্দুল করিমকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা ‘মহাজনের নাও’ নাটকের প্রর্দশনী এখনো করে থাকে। এছাড়াও ২০১৭ শাহ আব্দুল করিম জীবন নিয়ে ‘কূলহারা কলঙ্কিনী’ নামে উপন্যাস লিখেছেন সাইমন জাকারিয়া।

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের মধ্যে দিয়ে তাকে খুঁজতে প্রতিদিন ভক্ত ও স্বজনরা গানের আসর বসান। গানের মধ্যে তাকে বাঁচিয়ে রেখে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান ভক্ত-অনুরাগীরা। সে কারণেই তার গান সঠিক সুরে গাওয়া, গানগুলো সংরক্ষণ করা এবং তার নামে একটি একাডেমি নির্মাণের দাবি তাদের। সেই দাবি এখন পর্যন্ত পূরণ না হওয়ায় হতাশাও রয়েছে শাহ আব্দুল করিমের ভক্তসহ সংস্কৃতিকর্মীদের।

সংস্কৃতিকর্মী সোহান আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আগে তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমরা জোর দাবি জানাই, শাহ আব্দুল করিমের নামে একটি একাডেমি নির্মাণ হোক, যেখানে তার সব গান সংগ্রহ করে রাখা হবে।

সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামছুল আবেদীন সারাবাংলাকে বলেন, আব্দুল করিম ছিলেন বাঙালি জাতির একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। তিনি শুধু প্রেমের গানই লেখেননি, তিনি গরিব-দুঃখী মানুষের সঙ্গে ছিলেন। প্রতি বছরের মতো এবারও তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবে। তার নামে একটি একাডেমি স্থাপনের প্রক্রিয়াও চলমান। আপাতত জমি সন্ধানের কাজ চলছে। আমরা আশা করছি শিগগিরই তার নামে একাডেমির কাজ শুরু করতে পারব।

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, মুর্শিদ ধন হে, কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া, বন্ধে মায়া লাগাইছে, তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আমি কুলহারা কলঙ্কিনী, কোন মেস্তরি নাও বানাইলো, গাড়ি চলে না— এমন অসংখ্য জনপ্রিয় ও মুখে মুখে ফেরা গানের স্রষ্টা শাহ আব্দুল করিম। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকুক বা না থাকুক, এসব গানই ভাটির সুর সম্রাটকে বাঁচিয়ে রাখবে মানুষের মনে— ভক্ত-অনুরাগীরা সে বিশ্বাসই ধারণ করেন।

সারাবাংলা/টিআর

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ভাটির সুর সম্রাট শাহ আব্দুল করিম


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর