সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে না সার
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১১:০০
ঢাকা: কয়েক দফা কমিয়ে সারের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাকে সরকার নিজেদের অন্যতম সাফল্য বলে দাবি করে থাকে। এর মাধ্যমে সরকারের ‘কৃষিবান্ধব নীতি’র প্রতিফলন ঘটায় তা প্রশংসাও পেয়েছে। তবে এ বছর আবাদের মৌসুমে এসে দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে সার। সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি হচ্ছে— অনুমোদিত ডিলাররা এমনটি দাবি করলেও খুচরা বিক্রেতারাই স্বীকার করছেন বেশি দামে সার বিক্রির কথা।
একাধিক খুচরা বিক্রেতা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, ডিলাররা তাদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দাম রাখছেন। আর তারা বস্তা প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা কিংবা কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। অন্যদিকে কৃষকরা বলছেন, প্রকারভেদে বস্তায় এবার তাদের সারের জন্য ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে। খুচরা সার ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, চাহিদার তুলনায় ডিলাররা সার কম দেওয়ায় বাজারে দাম বেড়েছে। আর কৃষকরা বলছেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা সারের দাম বাড়িয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সারের দাম বেড়েছে— এমন তথ্য ‘মুখে মুখে শুনলেও’ তার প্রমাণ নেই খোদ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি মন্ত্রণালয় কিংবা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কাছে। এ পরিস্থিতিতে কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারে পক্ষ থেকে সারের বাজার আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকার নির্ধারিত দামেই ইউরিয়া সার প্রতি কেজি ১৬ টাকা, এমওপি প্রতি কেজি ১৫ টাকা, ডিএপি প্রতি কেজি ১৬ টাকা ও টিএসপি প্রতি কেজি ২২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, ডিলার ও খুচরা পর্যায়ে ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ মূল্য বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) ৮০০ টাকা, টিএসপি ১১০০ টাকা, ডিএপি ৮০০ টাকা ও এমওপি ৭৫০ টাকা।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে— নীলফামারী, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবার সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি হচ্ছে। এসব এলাকার বেশ কিছু খুচরা ব্যবসায়ী ও কৃষকরা সারাবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। যদিও এসব এলাকার সার ডিলাররা সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রির দাবি করছেন।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কৃষক মোস্তফা সারাবাংলাকে জানান, ইউরিয়া (যমুনা) প্রতি বস্তা ৮৫০ টাকা, ইউরিয়া (ঘোড়াশাল) প্রতি বস্তা ৯৫০ টাকা ও পটাশ প্রতি বস্তা ৯৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের চেয়ে এবার সারের দাম বেশি।
একই উপজেলার খুরশিদমহল গ্রামের একজন কৃষক সারাবাংলাকে জানান, ইউরিয়া সার ১ হাজার টাকা বস্তা ও পটাশ ৯০০ টাকা বস্তায় কিনেছেন তিনি। ওই এলাকার মাইজবাড়ি বাজারের সার বিক্রেতা মোফাজ্জল সারাবাংলাকে বলেন, আগে পটাশ সারের বস্তা ছিল ৭২০ টাকা। এ বছর ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ১৫ টাকা কেজি বিক্রি করলেও এখন বিক্রি করছেন ১৬ টাকায়। গত বছর এ সার প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) ৮০ টাকা বিক্রি করলেও এবার ৯০ টাকা পাল্লায় বিক্রি করেছেন তিনি। তবে ওই এলাকার কান্দিপাড়া বাজারের সার ডিলার রিটন সারাবাংলাকে জানান, ডিলার পর্যায়ে সারের দাম বাড়েনি। আগের দামেই সব সার বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা পর্যায়ে দাম কিছুটা বাড়তি থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার হরশী গ্রামের কৃষক হিমেল সারাবাংলাকে জানান, এবার সারের দাম বাড়তি। ইউরিয়া সার ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা বস্তায় বিক্রি হচ্ছে। আর চিকন ইউরিয়ার এক বস্তার দাম পড়ছে ১ হাজার টাকা। আর এক বস্তা পটাশ সারের দাম ৮০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘চাহিদার সময় সার ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে। দোকানে সার থাকলেও বলে সার নেই। মৌসুমের চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে তারা দাম বাড়তি রাখে।’
গাজীপুরের শ্রীপুরের কৃষক মোক্তার আলম সারাবাংলাকে জানান, সম্প্রতি ইউরিয়া সার ২০ টাকা কেজি ও পটাশ ২০ টাকা কেজি দরে কিনেছেন তিনি। নীলফামারীর কৃষক দৃজেন সারাবাংলাকে জানান, ইউরিয়া সার ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা বস্তায় বিক্রি হচ্ছে। আর পটাশ সার বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা বস্তায়। অন্য বছরের তুলনায় খুচরা পর্যায়ে এবার সারের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।
এদিকে, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ছোটবালিায় গ্রামের কৃষক মতলেব সারাবাংলাকে জানান, এবার সারের দাম খুব বাড়তি ছিল। সার পাওয়া যায়নি। টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সার ১৪০০ টাকা বস্তা দরেও কিনতে হয়েছে। আর ইউরিয়া বিক্রি হয়েছে ৯৫০ থেকে ৯৬০ টাকায়। পটাশ কিনতে হয়েছে ৯০০ টাকা বস্তায়। তিনি বলেন, ‘এখন সারের চাহিদা কম। কিন্তু মৌসুমের শেষ দিকে আবারও সার লাগবে। তখন কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা নিয়ে আমরা এখনই শঙ্কায় আছি।’
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালি ইউনিয়নের কৃষক রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ইউরিয়া সার ২০ টাকা কেজিতে কিনেছি। খুচরা বিক্রেতারা এবার সারের দাম বেশি রেখেছে।
সারের দাম সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি রাখার তথ্য স্বীকার করে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার খুচরা বিক্রেতা আনিসুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করেই ইউরিয়া, টিএসপি ও পাটশ সারের দাম বেড়ে গেছে। ৫০ কেজির প্যাকেটে ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, টিএসপি সারের দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, পটাশ সারের দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ১৪০ টাকা। সারের এই দাম সরকার বাড়িয়েছে নাকি ডিলাররা বাড়িয়েছে, সেটি বলতে পারব না। তবে সার আনতে গেলেই ডিলাররা বলেন, সার নেই। অতিরিক্ত টাকা দিলে দুয়েক প্যাকেট বের করে দেন।’
বাড়তি দামে সার বিক্রির তথ্য অস্বীকার করে লক্ষ্মীপুরের ডিলার ফারুক সারাবাংলাকে জানান, তাদের এলাকায় সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে হয়তো কিছুটা বেশি থাকতে পারে। তবে অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়েছে— এমনটি তাদের নজরে আসেনি।
নীলফামারীর ডিলার ওয়াহেদের দাবিও একইরকম। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি করছি। বর্তমানে ইউরিয়া ৮০০ টাকা বস্তা ও পটাশ ৭৫০ টাকা বস্তায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা হয়তো বস্তা প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি রাখছে। কারণ ডিলারের কাছ থেকে তাদের দোকানে সার নিতে ভ্যান ভাড়ার খরচ রয়েছে।’ তবে কিছুদিন আগে ওই এলাকায় সারের দাম কিছুটা বেশি ছিল বলে জানান তিনি। এছাড়া সাভার ও খুলনার দু’জনের ডিলারে সঙ্গে কথা বলেও সারের বাজার অপরিবর্তিত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
রংপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ডিলার পর্যায়ে সারের দাম বাড়েনি। তবে খুচরা পর্যায়ে বস্তা প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে। এ নিয়ে কৃষকদের তেমন কোনো অভিযোগ নেই। সেখানকার কৃষক আন্দোলনের নেতা আব্দুল কুদ্দুস সারাবাংলাকে জানান, সারের দাম একই রয়েছে। কৃষকদের অভিযোগ নেই।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক (সার ব্যবস্থাপনা) সৈয়দ রফিকুল আমিন সারাবাংলাকে বলেন, সারের দাম বেড়েছে— এমন কোনো লিখিত অভিযোগ আমরা পাইনি। কিন্তু মুখে মুখে শুনেছি সারের দাম বেড়েছে। কিছুদিন আগে সারের সরবরাহ নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, অনেকেই হয়তো তখন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সারের দাম বাড়িয়েছিল। কোনো উপজেলায় বাড়তি দামে সার বিক্রি হলে অবশ্যই উপজেলার কৃষি অফিসারকে জানানো উচিত। আমাদের কাছে যে রিপোর্ট আছে, দেশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে যে রিপোর্ট পাঠানো হয়, তাতে সরকার নির্ধারিত দামেই সার বিক্রি হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি রিয়াজ উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, কোনোভাবেই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি মূল্যে সার বিক্রির সুযোগ নেই। সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে বাড়তি মূল্যে কেউ সার বিক্রি করলে, সে ডিলারই হোক কিংবা সাব-ডিলার, তার ওই ডিলারশিপ বাতিল হবে। কেউ বাড়তি মূল্যে বিক্রি করে থাকলে সেখানে সারের অবৈধ বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল ইসলামও বলছেন, কিছু কিছু জায়গা থেকে বাড়তি দামে সার বিক্রির অভিযোগ শুনেছেন। খোঁজ নিয়ে এ অভিযোগের সত্যতা না পেলেও ঘটনা খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধান চালানো হবে বলেও জানান তিনি।
মাহবুবুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেসব যায়গা থেকে অভিযোগ পেয়েছি, সেই উপজেলাগুলোর কৃষি কর্মকর্তাদের বাজার পরিদর্শন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি সারের দোকানে লাল কাপড় টাঙিয়ে তাতে সরকার নির্ধারিত সারের দাম উল্লেখ করার কথা। তা নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছে কৃষি কর্মকর্তাদের। আইনেও এটি রয়েছে। কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরিফুজ্জামান শরিফ সারাবাংলাকে বলেন, এবার সারের মজুত আছে। কিন্তু বেশি দামে কৃষককে সার কিনতে হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বস্তা প্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারে উচিত সারের বাজার আরও গভীরভাবে মনিটরিং করা। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সারের বাজার পর্যবেক্ষণ করা উচিত। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা উচিত— কেউ নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করতে পারবে না। কোথাও বেশি দামে সার বিক্রি হলে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে অভিযোগ করার ব্যবস্থাও থাকা উচিত।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর