কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে: কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নকে ধরলা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষায় সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় আড়াই কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়েছে। তবে প্রায় এক কিলোমিটারের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু প্রায় নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় লোকজন পাড় বাঁধাই কাজে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)।
এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, বাজেট হয়েছে সোজা বাঁধ করার জন্য। কিন্তু নদী যেদিকে ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে ঠিকাদার মেরামত করতে চান সেদিকের পাড়। এতে তারা কম টাকায় কাজ শেষ করতে পারবেন। এছাড়া সোজাসুজি বাঁধ নির্মাণ না করলে ভাঙন কবলিত অংশের জমি খাস হয়ে যাবে। এসব ধারণা থেকে মোগলবাসা ইউনিয়নের সিনাই খামার গ্রামের নীধিরাম পয়েন্টের লোকজন পাড় বাঁধাই কাজে সরাসরি বাধা দিচ্ছেন। এমনকি বলা হচ্ছে, টেন্ডারের ১২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে ঠিকাদার।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সোজাসুজি আগের রাস্তা বরাবর যে বাঁধ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তার টেন্ডার এখনও হয়নি। টেন্ডার হয়েছে ভাঙন কবলিত এলাকার ভেতরে ঢুকে যাওয়া অংশের পাড় বাঁধাই কাজের। কিন্তু স্থানীয় কিছু লোক সেই কাজ করতে দিচ্ছেন না। কেউ তাদের ভুল বুঝিয়েছে। আর পাড় বাঁধাই করলে জমি খাস হয়ে যাবে এমন কোনো বিধান নেই। বরং যখন সোজাসুজি বাঁধ নির্মাণ হবে তখন ওই জমিগুলো থেকে আরও ভালো ফসল ফলাতে পারবে জনগণ।’
আরিফুর রহমান আরও বলেন, ‘যে টেন্ডারের কাজ শুরুই হয়নি সেখানে ঠিকাদারকে বিল দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। একান্তই যদি টেন্ডার বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হয় তখন হেড অফিসে একটি মিটিং করে এটি সমাধান করবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এমনকি টাকা ফেরতও যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এখানে পাড় বাঁধাই করা হলে জনগণের লাভ হবে। সেই জনগণই যদি না বোঝে তাহলে কার কী করার আছে? আমরা একাধিকবার জনগণকে বুঝিয়েছি। কিন্তু কেউ তাদের ভুল বোঝানোর ফলে কাজ শুরু সম্ভব হচ্ছে না।’
সম্প্রতি মোগলবাসা ইউনিয়নের সিনাই খামার গ্রামের ওই পয়েন্টে গেলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। এ সময় নারী–পুরুষ মিলে প্রায় ৫০–৬০ জন লোক জড়ো হয়। এর মধ্যে আব্দুল আজিজ নামে একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্যের লোকজন জানিয়েছে, এখানে রাস্তা বরাবর ভেঙে যাওয়া অংশে মাটি ভরাট করে বাঁধের টেন্ডার হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার পাড় বাঁধাই কাজ করতে চাচ্ছে। সেজন্য আমরা বাধা দিই। এতে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলার ভয় দেখিয়েছে ঠিকাদার। আমরা চাই পুরনো রাস্তা বরাবর (পানির অংশ) বাঁধ দেওয়া হোক।’
আম্বিয়া খাতুন নামের এক বাসিন্দা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই আমরা এই বাঁধ নির্মাণের পরিবর্তে পাড় বাঁধাই করতে দেব না। তাতে মামলা হোক, আর জেলে যাওয়া লাগলেও যাব। স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজেই এই পাড় বাঁধাইয়ের বিরুদ্ধে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য (জাতীয় পার্টি) পনির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন সংসদ সদস্য হিসেবে কোনো কিছুই জানি না। বাজেট হয়েছে এটুকুই জানি। কেউ কোনো দিন আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। জনগণ এখানে কাজে বাধা দিচ্ছে। তবে কী কারণে বাধা দিচ্ছে আমার তা জানা নেই। হয়তো কাজে অনিয়ম হচ্ছে, তাই সাধারণ জনগণ বাধা দিচ্ছে। নির্বাহী প্রকৌশলীও কোনোদিন আমাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে কিছু জানায়নি। এ সব বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে পনির উদ্দিন বলেন, ‘আমি জনগণকে বলিনি যে, আপনারা কাজ করতে দিয়েন না। এমনকি আমার লোকজন যদি বলে থাকে, সে বিষয়ও আমার জানা নেই। আমি নিজের ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করি সব সময়।’
স্থানীয় সংসদ সদস্যের এ রকম মন্তব্যের বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, ‘এমপি সাহেব নিজে কাজের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছেন। এরপর বিভিন্ন সময় তাকে ফোন করেছি। কিন্তু তার এসব কাজে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এরপর যদি উল্টো অভিযোগ করেন তবে বলার কিছু নেই। উনি সংসদ সদস্য। প্রত্যেকটি কাজের একটি করে কমিটি থাকে। সেই কমিটির বাইরে কোনো কিছু করার সুযোগ নেই আমার। কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, তার সবকিছু মূল্যায়ন কমিটি দেখে সেটাকে অনুমোদন দেয়। তারপর কাজ শুরু হয়। এমনকি বিল পেমেন্টের ক্ষেত্রেও কমিটির অনুমোদন লাগে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার জবাবদিহিতার জায়গাটা অনেক বড়। সবকিছুতেই ওপরের কর্মকর্তাদের অনুমতি লাগে। সামান্য ভুল হলে সেটি আটকে যায়। কাজেই এখানে অনিয়ম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’