হয়নি কয়লার জোগাড়, রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সংশয়
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:০৩
ঢাকা: উৎপাদনে আরও পিছিয়ে যেতে পারে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামী তিন মাসের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও এখনও কয়লার জোগাড় হয়নি। এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজও শেষ করা যায়নি। ফলে ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা যাবে কিনা সংশয় দেখা দিয়েছে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের এখনও অনেক কাজ বাকি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের শুরুতে কাজের যে গতি ছিল করোনায় তা অনেক কমে গেছে। তবে কয়লা পাওয়া গেলে আগামী নভেম্বরের শেষ নাগাদ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা যেতে পারে।
দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সাপমারি- কাটাখালী ও কৈর্গদাশকাঠী এলাকায় ১ হাজার ৮৩৪ একর জমির ওপরে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী- রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা সই হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে দুই দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিপিডিবি ও এনটিপিসি যৌথ কোম্পানি গঠন করে। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়।
২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহবান করে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় ২০১৬ সালের ১২ জুলাই। ইকুইটি বিনিয়োগ সমান ভাগে ধরে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট রামপাল বাস্তবায়নে গঠন করা হয় বাংলাদেশ- ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড- বিআইএফপিসিএল।
১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল। বাস্তবায়নকারী কোম্পানি বিআইএফপিসিএলের তথ্য অনুযায়ী কাজ শুরুর তারিখ থেকে ৪১ মাসের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে হবে। সে হিসেবে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরেই রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনসক্ষম হয়ে ওঠার কথা।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী গত আগস্টে এর উৎপাদন শুরুর কথা থাকলেও করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এখন আসছে ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। যদিও এখনও এর কয়লা আমদানি সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়নি। কাজ শেষ হয়নি সঞ্চালন লাইন নির্মাণেরও। ফলে ডিসেম্বরেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে যেতে পারবে কিনা এ নিয়ে সংশয় সংশ্লিষ্টদের।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের সরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও রামপাল প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা পাওয়ার সেল এর মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রামপালের কাজ চলছে। তবে কয়লার বিষয়টি এখনও সুরাহা ওভাবে হয়নি। আশা করছি, ওটা হয়ে যাবে। আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছি ইন্দোনেশিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়া থেকেই আমরা কয়লা নেব। আমাদের লক্ষ্য ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিট শুরু করা। সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।’
বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার প্রধান উপাদানই কয়লা তার সংস্থান এখনও করা যায়নি, সেখানে নভেম্বরে পরীক্ষামূলক কিংবা ডিসেম্বরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে কী করে যাওয়া যাবে? এ প্রশ্নের জবাবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, ‘কথা চলছে আমরা দ্রুতই এগোচ্ছি। আশা করছি সমাধান হয়ে যাবে।’
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মূল কাজ শেষ করতে দেরী হলেও ভূমি উন্নয়ন কাজ, সীমানা প্রাচীর ও স্লোপ প্রোটেকশন কাজ, মূল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফেসিং কাজ, নির্মাণ কাজের বিদ্যুৎলাইন, নির্মাণ কাজের পানিসহ বেশ কিছু কাজের পুরোটাই শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন দুটি ইউনিট মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৬৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে একটি ইউনিটের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আফসার উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়লা কীভাবে কোথা থেকে আসবে সেটা আমার আওতার বাইরে ইস্যু। কয়লা দিলে আমি কাজ শুরু করতে পারব। সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ শেষ। আর ৬৬০ মেগাওয়াটের যে প্রথম ইউনিট আমরা ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করার পরিকল্পনা করছি সেটার অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। বাকি সময়ের মধ্যে ২০ শতাংশ শেষ করা যাবে। কারণ অল্প কিছু কাজ বাকি আছে।’
তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ রোধে বিধিনিষেধ এর কারণে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করতে পারেনি। এখন বেশি সংখ্যক জনবল নিয়োগ করে দ্রত কাজ শেষ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাবস্টেশন এর কমিশনিং করা, চিমনির কিছু কাজ বাকি, এফজিডি এর কিছু কাজ বাকি আছে, ওয়াটার সিস্টেমের কিছু কাজ বাকি। যন্ত্রপাতি চলে এসেছে। টারবাইন জেনারেটর স্থাপন হয়ে গেছে। এখন ভেতরে ফ্লাশিং হবে, কন্ট্রোল সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এসব প্রতিটি জিনিস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আফসার উদ্দীন আরও বলেন, ‘কয়লা পাওয়া গেলে এসব কাজ দ্রুত শেষ করে আগামী নভেম্বরে শেষ দিকে আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিং শুরু করতে পারব। তবে এখানে অনেকগুলো আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। যেমন, কয়লা প্রকিউরমেন্ট ইভ্যুলেশন পর্যায়ে আছে, এখনও চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত হলেই আমরা ঠিক করতে পারবো কবে পরীক্ষামূলক উৎপাদন বা কমিশনিং কখন শুরু হবে। কয়লা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছেনা। তবে আমাদের লক্ষ্য নভেম্বরের মধ্যেই কয়লা নিয়ে আসতে চাই। তবে আমাদের টার্গেট ডিসেম্বরে একটা ইউনিট চালু করে দেওয়ার। আমরা এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব।’
বাংলাদেশ ও ভারত সরকারে যৌথ বিনিয়োগে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন-এনটিপিসি যৌথ কোম্পানি গঠন করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সুন্দরবনের কাছে হওয়ায় প্রকল্প শুরুর আগে থেকেই রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান নিয়ে দেশের পরিবেশবাদীদের আপত্তি ছিলো। তাদের বক্তব্য, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কারণে রামপাল প্রকল্প পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং নিকটবর্তী সুন্দরবনে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনবে।
সরকার এর বিপক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছে যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের কোনো ধরনের ক্ষতি করবে না। নষ্ট হবে না সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। ওই সময়ে কয়েক দফা সময়সূচি পিছিয়ে ২০২১ সালের জুনে প্রথম ইউনিট চালু করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে কাজ বন্ধ থাকায় তা আরও পিছিয়ে এ বছরের ডিসেম্বরে চালুর দিন ঠিক করা হয়।
প্রথম ইউনিট ডিসেম্বরে চালু হলে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে ২০২২ সালের মার্চ মাসে। এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদনের বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা এরইমধ্যে বাংলাদেশ অর্জন করে ফেলেছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশও উৎপাদনে আসতে না পারা এমন কয়লাভিত্তিক দশ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে। এর বদলে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপরে। গুরুত্ব রয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস-এলএনজি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপরও।
সারাবাংলা/জেআর/একে