Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্কলাসটিকা কর্মকর্তা ইভানার মৃত্যুর নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:২৬

স্বামী রুম্মানের সঙ্গে ইভানা

ঢাকা: রাজধানীর শাহবাগ থানার নবাব হাবিবুল্লাহ রোডে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পেছনে) দুটি ভবনের মাঝখান থেকে ইভানা লায়লা চৌধুরী (৩২) নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই নারী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্কলাসটিকার ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সিলর ছিলেন।

পুলিশ বলছে— ইভানার মৃত্যু নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে। তার স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান ওরফে রুম্মানের আচরণ সন্দেহজনক। ঘটনার দিন ইভানার  স্বামী কিংবা শ্বশুর বাড়ির লোকজন কেউ সহযোগিতা করেনি। এমনকি ইভানা মর্গে থাকলেও তাদের কেউ হাসপাতালে যাননি।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইভানার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ইভানার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে সারাবাংলা ডটনেট।

ইভানাকে গুরুতর জখম অবস্থায় উদ্ধারকারী শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্বাস আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ খবর পেয়ে বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে আমি ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে দুটি ভবনের মাঝে ওই নারীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। এরপর তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ইভানাকে মৃত ঘোষণা করে।’

এসআই আরও বলেন, ‘আমি অবাক হলাম, ওই নারীর পরিবারের কেউ মরদেহের সঙ্গে এলো না। মনে হলো তাদের কোনো অনুভূতিও নেই। আমরাই তার মরদেহ নিয়ে এলাম। বিষয়টি একটু অন্যরকম ঘটনা মনে হচ্ছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তদন্ত হবে নিরপেক্ষভাবে। পেছনে কোনো ঘটনা থাকলে সেটিও তদন্তে বের হয়ে আসবে।’

বিজ্ঞাপন

পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে তোলা ছবি। ডান পাশে ইভানা লায়লা চৌধুরী

বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঘটনাস্থলে গেলে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। আব্দুর রহিম নামে একজন নিরাপত্তাপ্রহরী বলেন, ‘ওই নারী ৯ তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। উচ্চশব্দে কিছু একটা পড়ার শব্দে অনেকে দৌড়ে যান। আমরাও কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম। এরপর কেউ একজন ৯৯৯ কল সেন্টারে ফোন করে ঘটনাটি পুলিশকে জানায়।’

আব্দুর রহিম আরও বলেন, ‘বেশ কিছুদিন হলো স্বামীর সঙ্গে তাকে বের হতে দেখিনি। দুই ছেলেকে নিয়ে ইভানাকে বের হতে দেখেছিলাম কয়েকদিন আগে। তবে ওই সময় চুপচাপ থাকতে দেখেছি।’

ইভানা তার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে পরীবাগের ২/ক/১৪ ভবনের ফ্লাট-৫ এ থাকতেন। ওই ভবনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী বলেন, ‘ইভানাকে চিনতাম। আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বছরখানেক হলো ইভানাকে মানসিকভাবে দুর্বল মনে হতো। কথাবার্তা কম বলত। একদিন তার কাছে ঘটনা জানার চেষ্টা করেছি। তখন সে জানায়, তার স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান ওরফে রুম্মান অন্য এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এ নিয়ে সংসারে ঝামেলা যাচ্ছে। রুম্মান এই কারণে ইভানাকে সহ্য করতে পারত না। মাঝেমধ্যে ইভানার গায়ে হাত তুলত। তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও করত।’

‘ইভানাও তেমন একটা কারও সঙ্গে মিশতে চাইতেন না। দুই বাচ্চাকে নিয়ে ঘরেই সময় কাটাতেন। কখনও-সখনও দুই বাচ্চাকে নিয়ে বের হলেও মনমরা হয়ে থাকত—বলেন ইভানার পরিচিত ওই নারী।

সন্তানের সঙ্গে ফ্রেমে বন্দি ইভানা

রুম্মানের ঘনিষ্ঠ একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইভানাকে নানাভাবে অত্যাচার করত। শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হতো— রুম্মান আরেকটি বিয়ে করলে তোমার ক্ষতি কোথায়? ছেলে মানুষ বাইরে কারও সঙ্গে মিশতেই পারে। সে ব্যারিস্টার। নানা জায়গায় নানা মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় থাকতেই পারে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইভানার শ্বশুর মো. ইসমাইল হোসেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। নিহতের স্বামী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী। ইভানার সঙ্গে রুম্মানের ২০১১ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। সংসারে এই দম্পতির দুটি ছেলে রয়েছে।

ওই ভবনের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে ইভানা চিৎকার করত। চিৎকার করে তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি। কান্নাকাটিও করতে শুনেছি। এ জীবন তিনি আর রাখবেন না বলেও শুনেছেন। ইভানা বলত, আমাকে ঘরে রেখে আরেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করো, এর পরিণাম ভালো হবে না। রুম্মানও তখন বলতেন, তুই এই বাড়ি থেকে চলে যা। খুব ভালো থাকতে পারব। এমনকি ঘটনার দিন সকালেও তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়েছে।’

শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) আরেক অনুসন্ধানে জানা যায়— প্রায় এক বছর ধরে ইভানা থাইরয়েড সমস্যাসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য ইভানাকে গত ৬ এপ্রিল রুম্মানের পরিচিত ডাক্তার কিডনি স্পেশালিস্ট অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক মোল্লার কাছে নিয়ে যান। তিনি ইমপালস মেডিকেলে বসেন। ওই চিকিৎসক কোনো প্রকার ডায়াগনসিস ছাড়াই থাইরয়েড ও মানসিক চিকিৎসা শুরু করেন। লিখে দেন কিছু ওষুধ। ইভানা এসব ওষুধ নিয়মিত খেতেন।

ইভানার মৃত্যুর বিষয়ে তার স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসানকে ফোন করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর তার বাসায় গিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি সাক্ষাৎ করেননি।

তবে আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসানের এক আত্মীয় সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইভানার মানসিক সমস্যা ছিল। সামান্য কোনো কিছু হলেও সে আত্মহত্যার চেষ্টা করত। ঘটনার দিন সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছে। আর তাতেই ইভানা ৯ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।’

১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ইভানার ময়নাতদন্ত হয়। মর্গে ময়নাতদন্তের সময় উপস্থিত ছিলেন ইভানার শ্বশুর, শ্বশুরের এক বন্ধু ও ইভানার স্বামীর এক ফুফাতো ভাই।

ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক কিছু না জানালেও মর্গ সূত্রে জানা গেছে, মৃতদেহ থেকে ভিসেরা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। মৃতের মাথার পেছনে আঘাত ছিল। কোমর ও পা ভাঙা ছিল।

এর আগে, ইভানার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন শাহবাগ থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) কামরুন্নাহার। তিনি সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করেন, মৃতের মাথার পেছনে ফোলা আঘাত ছিল। ডান হাত কনুইয়ের নিচে ভাঙা ছিল। বাম হাতে ব্লেড দিয়ে কাটা পুরনো কুচিকুচি দাগ ছিল। তলপেটে গভীর কাটা, কোমর ভাঙা, ডান পা হাঁটুর নিচে ভাঙা ছিল।

ইভানা যে কোনো কারণে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছিল তার এক ফেসবুক কমেন্টে প্রমাণ মেলে। সেখানে অন্য এক নারীর সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন।

সেই কমেন্টে ইভানা লেখেন, ‘তুমি খুব ভাগ্যবান যে, তোমার স্বামীকে তুমি পাশে পেয়েছ। আমার দ্বিতীয় সন্তান অটিজমের শিকার, তার বিকাশ ঘটেছে দেরিতে। আমার নাবালক সন্তানের চ্যালেঞ্জগুলো আমাকে ধৈর্য্যশীল করেছে কিন্তু তার বাবার হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় আমার স্বামী একজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। ওই নারীর একটি ছেলে সন্তানও আছে।.. জীবনটা একটি কঠিন জার্নি, বিয়ের ১০ বছর পর আমার উপলব্ধি হলো, সত্যিই নিশ্বাস নিতে পারা কষ্টকর। আমি সিঙ্গেল জীবন কাটাব তার জন্য প্রস্তুত নই। আমার দুই সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই। কেননা আমাদের সমাজ সবসময় ছেলেদের পক্ষে। আমি আজ এখানে লিখছি, এক মাস হাসিমুখে থাকার পরও আমি মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার ছোট সন্তান আমাকে মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরিয়ে আনছে। এই অবুঝ শিশুদের মধ্যে অদ্ভুত শক্তি রয়েছে!”

কোনো এক ফেসবুক বন্ধুর স্ট্যাটাসে ইভানার কমেন্টস

ইভানা লায়লা চৌধুরীর বাবা আমান উল্লাহ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি মামলা করব। তবে মানসিকভাবে একটু শক্ত হতে হবে আমাদের। আজকে কেবল মেয়েকে দাফন করা হলো।’ মামলার পাশাপাশি সুপ্রীম কোর্টে বার অ্যাসোসিয়েশনেও অভিযোগ দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে আমান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মেয়ে কোনোদিন কোনো অভিযোগ দেয়নি। কিছু জানালেও হয়ত আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এমনকি জামাই যে, পরকীয়া প্রেমে জড়িয়েছে তাও বলেনি কোনোদিন। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর জানতে হলো। এই মুত্যুর পেছনে অনেক রহস্য রয়েছে বলে ভাবছি।’

ইভানার বাবার বাড়ির একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ সাধারণ তো প্রাথমিক তদন্তে মৃতের থাকার জায়গা, লাফ দেওয়ার স্থান, ঘটনাস্থল, সুরতহাল রিপোর্ট, এমনকি অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে। কিন্তু শাহবাগ থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সুরতহাল রিপোর্ট ছাড়া কোনো কিছুই করেনি। ইভানা যে ঘরে থাকতেন সেখানেও যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ইভানা তো লাফ নাও দিতে পারেন। তাকে তো ধাক্কা দিয়েও ফেলা হতে পারে। সে জন্য ভালোভাবে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন মনে করছি। পরিবারের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি করছি। ইভানার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেই অনেক কিছু বের হবে বলে মনে করছি আমরা।’

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলেন, ‘ইভানার মৃত্যুর বিষয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। সেটিকে ধরে আমরা তদন্ত করছি। অনেকেই এই মৃত্যুর পেছনে রহস্য আছে বলে দাবি তুলেছেন। আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এলে আমরা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।’

এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘কেউ তদবির করেনি। মৃত ইভানার শ্বশুর একজন সাবেক সচিব বলে শুনেছি। তবে তিনি থানায় আসেননি বা ফোনও করেননি। বরং তাদের কাউকে ডেকেও আমরা পাইনি। তাদের পরিবারে একজন মারা গেছে। সবার আগে তো তাদেরই এগিয়ে আসার কথা। কিন্তু তারা আসেননি।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘আমাদের একটি তদন্ত টিম ইভানার বাসায় গিয়ে কোনো সুইসাইডাল নোট পায়নি। তিনি আত্মহত্যার সময় ফোনে কথা বলেছেন কিনা সে বিষয়টিও জানা নেই। আমরা তার কল লিস্ট চেক করব। এ ছাড়া এই মৃত্যুর পেছনে কেউ দায়ী থাকলে তাকেও আইনেও আওতায় আনা হবে।’

সারাবাংলা/ইউজে/একে

আত্মহত্যা ইভানা লায়লা চৌধুরী ব্যারিস্টার রুম্মান স্কলাসটিকার শিক্ষিকা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর