মাতৃভাষায় পড়ালেখা করতে না পারার আক্ষেপ মথুরা বিকাশের
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মাতৃভাষায় পড়ালেখা করতে না পারার আক্ষেপের কথা জানিয়ে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকপ্রাপ্ত’ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেছেন, ‘মাতৃভাষা প্রয়োগ করতে না পারলে হৃদয়ে ক্ষরণ তৈরি হয়। তাই সব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। একটি ভাষা হারিয়ে গেলে সেই ভাষাকে কেন্দ্র করে যে জ্ঞানব্যবস্থা তা হারিয়ে যাবে। কোনো ভাষা হারালে এদেশের বৈচিত্র্যের যে সৌন্দর্য, সেটা হারাবে।’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকপ্রাপ্তি উপলক্ষে শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘পিপলস ভয়েস’ আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা এসব কথা বলেন।
মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘মাতৃভাষায় যখন কথা বলতে পারি না, তখন মনে হয় যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শৈশব থেকে মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। শিক্ষার প্রয়োজনে অন্য একাধিক ভাষা শিখেছি। ভাষার আকুতি আমার কাছে নিঃশ্বাসের মত। মাতৃভাষা প্রয়োগ করতে না পারলে ভেতরে ক্ষরণ তৈরি হয়।’
‘এদেশের মানুষ ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিল। সেই চেতনার সিঁড়ি বেয়ে স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশ। আমরা গর্ববোধ করি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের জন্য। সারাবিশ্বের মানুষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজ নিজ ভাষার গৌরব উদযাপন করে। এই স্বীকৃতি আমার জন্যে গর্বের। শুধু আমার মাতৃভাষা নয়, সকলের মাতৃভাষা নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব তৈরি হয়েছে। সরকার ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতিসত্তার ভাষার বিপন্নতার মাত্রা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন মথুরা ত্রিপুরা।
উল্লেখ্য, চলতি বছর থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রথমবারের মতো পেয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণ, শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, আর্থ-সামাজিক বিষয়, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রচলনসহ বিভিন্ন বিষয়ের গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীন আখতার বলেন, ‘আমাদের দেশে মিশ্র সংস্কৃতি। অনেক ভাষাভাষি লোক পাশাপাশি আছি। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে। বাংলাদেশের আপামর মানুষের মাতৃভাষা সংরক্ষিত হোক, চর্চা হোক এটাই আমরা চাই। যদি একটি জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভাষা চর্চা করতে না পারে তাহলে তারা এগিয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে ক্ষুদ্র মন নিয়ে আগাতে পারব না। যারা আছে সবাইকে নিয়ে আগাতে হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গবেষক শরীফ শমশির বলেন, ‘প্রতি ভাষায় একজন করে বিদ্যাসাগর থাকেন, যিনি নিজ মাতৃভাষার বর্ণমালা ও ভাষার ভিত্তি গড়ে দেন। ত্রিপুরা ভাষায় অন্যতম বিদ্যাসাগর মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। বাংলাভাষীদের অনেক ধন আছে, অনেক দীনতাও আছে। আমরা বাংলা-ইংরেজি জানি। ত্রিপুরা ভাষা জানি না। সংবিধান প্রণয়নের সময় জাত্যাভিমানের কারণে অন্য জাতিসত্তাদের আমরা ধারণ করতে পারিনি। বিষয়টি বাঙালি-পাহাড়ির দ্বন্দ্ব নয়। চলমান নিওলিবারেল বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি দরিদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে কত দূর নেয়া যাবে? বাংলাও আজ চাপের মুখে। যত আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি তত মননে থাকা ঔপনিবেশিক শিক্ষা বেরিয়ে আসছে। এ পরিস্থিতিতে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা শুধু ত্রিপুরাদের নন। যাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে বিশ্ব পরিসরে তিনি তাদের সকলের প্রতিনিধি।’
লেখক-সাংবাদিক নজরুল কবীর বলেন, ‘ভাষার লড়াই শুধুমাত্র ভাষার সংগ্রাম না। মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা একটি প্রদীপ জ্বেলেছেন। শত প্রদীপ জ্বালাতে হবে। বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইয়ে ত্রিপুরারা সম্পৃক্ত ছিলেন। অথচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের মধ্যে কতজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, সেটাও আমরা জানি না। ভাষা-সংস্কৃতি টিকে না থাকলে শুধু চেহারার ভিন্নতাই থাকবে, সত্যিকারের জাতি পরিচয় টিকবে না।’
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের গ্রন্থাগার সম্পাদক মিন্টু চৌধুরী বলেন, ‘সমতলের মানুষ যতটা এগিয়ে থাকে, সে সুযোগ আদিবাসী জনগোষ্ঠী পায় না। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠী নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার বিশ্বস্বীকৃত। আমাদের দেশে নানা জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার পথে। যেসব জনজাতির সংখ্যা কম, তাদের ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া খুব জরুরি। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক দিনময় রোয়াজা, পিপলস ভয়েসের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আতিকুর রহমান।
সারাবাংলা/আরডি/এমও