বিচারপতি সংকটে ব্যাহত উচ্চ আদালতের বিচারকাজ
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১১:২১
ঢাকা: সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে মামলার সংখ্যা বাড়লেও কমছে বিচারপতির সংখ্যা। গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যক বিচারপতি নিয়ে চলছে আপিল বিভাগ। কয়েক বছর আগেও আপিল বিভাগে যেখানে ১১ জন বিচারপতি ছিল, বর্তমানে সেখানে আছেন মাত্র পাঁচজন। আর হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছেন ৯১ জন বিচারপতি।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যাবেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। একই সময়ের মধ্যে হাইকোর্টেরও বেশ কয়েকজন বিচারপতি অবসরে যাবেন। এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে দ্রুত বিচারপতি নিয়োগ দেবেন এমনটাই প্রত্যাশা করছেন আইনজীবীরা।
তাদের চাওয়া অল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতি উচ্চ আদালতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। তবে আইনমন্ত্রী বলছেন সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া।
করোনা সংক্রমণ কমে আসায় গত ১১ আগস্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের সকল বেঞ্চে ভার্চুয়ালি বিচারকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে গত ২৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এর বিচারপতি আমির হোসেনের মৃত্যুজনিত কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে কবে নাগাদ নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কেউই নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট থেকে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের (আচরণবিধি লঙ্ঘন) অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান থাকায় তারাও বিচারকার্য থেকে বিরত রয়েছেন।
বিচারপতি সংকটের কারণে তৈরি হওয়া মামলাজট করোনা মহামারির কারণে আরও বেড়েছে। এর ফলে ভোগান্তি বেড়েছে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষের। মামলাজট নিরসনে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বর্তমানে আপিল বিভাগের মাত্র একটি বেঞ্চ পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচ বিচারপতি কাজ করছেন। আর হাইকোর্ট বিভাগে ৫৩টি বেঞ্চ পরিচালনা করা হচ্ছে। চলতি বছর হাইকোর্ট বিভাগের আরও কয়েকজন বিচারপতি অবসরে গেলে মামলাজট আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফৌজদারি ও সাংবিধানিক আইন বিষয়ক ‘ল চেম্বার’, ল’ ল্যাব এর হিসেবে অনুযাযী- ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ হাজার ২২৫টি। অর্থ্যাৎ গড়ে বিচারপতিদের মাথাপিছু মামলা ৩ হাজার ৪৫টি। আর হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৬৩টি। হাইকোর্ট বিভাগের ৯১ জন বিচারপতির জন্য গড়ে মাথাপিছু মামলা রয়েছে ৪ হাজার ৯২৩টি। তবে সুপ্রিম কোর্টে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কী পরিমাণ মামলা নিস্পত্তি হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
ল’ ল্যাব এর তথ্য মতে, ১৯৭৪ সালে আপিল বিভাগে বিচারপতি ছিলেন পাঁচজন। আর সে সময় মামলা ছিল ৪ হাজার ৯৪টি। একই সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি ছিল ১২ জন। আর হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ১৮৬টি।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে দুইজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। তার আগে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর তিনজন বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আইনজীবীরা জানান, বর্তমানে উচ্চ আদালতে মামলার তুলনায় বিচারপতির সংখ্যা অনেক কম। সংবিধানের ৯৪ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি সংখ্যা নির্ধারণ ও নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
সংবিধানের ৯৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি (যিনি ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ নামে অভিহিত হইবেন) এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যে সংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনবোধ করবেন, সেই সংখ্যক অন্যান্য বিচারক লইয়া সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হইবে।’ সংবিধান অনুযায়ী ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদে থাকা যায়।
জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই যোগ্য বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। যোগ্য বিচারপতি নিয়োগ না দিলে বিচার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে রাখা যায় না। দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।’
সাবেক আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আদালতে লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে। এত মামলা শুধু বিচারক নিয়োগ দিয়ে সমাধান করা যাবে না। মামলার প্রয়োজনীয়তা দেখতে হবে। অপ্রয়োজনীয় মামলার বিষয়ে বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সত্যিকারভাবে কোন মামলাগুলো চলা উচিত সেগুলো বাছাই করে আগে শুনানি করা উচিত। আর দ্রুত মামলা নিস্পত্তির জন্য বিচারকদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুছ কাজল সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি সংকট রয়েছে। তবে শুধুমাত্র বিচারপতি নিয়োগ করলেই হবে না। যোগ্যতা সম্পন্ন বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে। আর বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য, মেধাবী ও দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য দেখে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ হলো- মিথ্যা ও ভুয়া মামলা, হয়রানিমূলক মামলা, রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা তথ্যে দিয়ে মামলা করা। এ সব কারণে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মিথ্যা ও ভুয়া মামলার কারণে আদালতের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হচ্ছে। বিচারক নিয়োগের পাশাপাশি মিথ্যা, ভুয়া ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করতে হবে। তাহলে মামলার সংখ্যা হ্রাস পাবে।’
উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ একটা চলমান প্রক্রিয়া। আশা করছি খুব শিগগিরই বিচারপতি নিয়োগ হবে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও বিচারপতি দেওয়া হবে।’
তবে বিচারপতি নিয়োগের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি খুব শিগগিরই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেবেন।’
সারাবাংলা/কেআইএফ/একে