জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দাবি
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:৪০
দেশে একটি সুষ্ঠু মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতির কারণে এগুলো সাধারন বর্জ্যের সঙ্গে মিশে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নাসফসহ ১৩টি সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে তাই একটি কার্যকর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দাবি করা হয়েছে।
শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘নামসর্বস্ব মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়; মেডিকেল বর্জ্যরে কার্যকর ব্যবস্থাপনা চাই’ শিরোনামের এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তারা বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহর, পৌরসভায় মেডিকেল বর্জ্য একটি বড় সমস্যা যা করোনাকালে আরও প্রকটভাবে দৃশ্যমান। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য রাজধানীর চার পাশের নদীসহ হাসপাতালগুলোর সামনের খোলা ডাস্টবিন অথবা নর্দমায় ফেলা হচ্ছে যার ফলে ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। খোদ রাজধানীর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থা থেকে সারা দেশের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায় বলে দাবি করেন তারা।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মেডিকেল বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের কলেবর বাড়ার ফলে ডিসপোজিবল বা একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। তন্মধ্যে অত্যন্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ মেডিকেল বর্জ্যের তালিকায় রয়েছে ব্যবহৃত সূঁচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, টিউমার, ওষুধের শিশি, রক্তের ব্যাগ, স্যালাইন ব্যাগ, মেয়াদোর্ত্তীণ ওষুধ, ক্ষতিকর রাসায়নিক ইত্যাদি।’
এসব বর্জ্যের মাধ্যমে নানা ধরণের সংক্রামক রোগিব্যধি ছড়িয়ে পড়ছে। টাইফয়েড, কলেরা, যক্ষ্মা, আমাশয়, ডায়রিয়া, এইচআইভিসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, জন্ডিস, নিউমোনিয়া ও এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাক্টেরিয়ার বিস্তারজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছে জনসাধারণ। এছাড়া হাসপাতাল থেকে নির্গত পানির মাধ্যমে সালমোনেলা এবং শিগেলা প্রজাতির জীবাণু ছড়ায়। এ বর্জ্য পানিতে বিদ্যমান অতিমাত্রায় বিষাক্ত ধাতু ও রাসায়নিক উপাদান যেমন ট্রাইক্লোরো ইথিলিন, সীসা, আর্সেনিক, বেনজিন, তামা, জিংক, ক্যাডমিয়াম, নিকেল ইত্যাদি যা চর্মরোগসহ মারাত্মক ধরনের রোগের সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিতভাবে এন্টিবায়োটিকসহ নানা উপাদান পানি ও মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে বলে সমাবেশ থেকে দাবি করা হয়।
বক্তারা আরও বলেন, স্বাস্থ্য অদিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রাথমিক, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৪৫টি এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ৯৪টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৪৪৫২টি, ক্লিনিক ২২৩৬টি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১০২৯১, সর্বমোট ১৬৯৭৯টি। ২০০০ সালে ছিল যথাক্রমে ১১২৫টি, ৬৩৩টি, ১৭৭৮টি, সর্বমোট ৩৫৩৬টি। দুই দশকে হাসপাতাল বেড়েছে চারগুণ, ক্লিনিক সাড়ে তিনগুণ, ডায়গনোস্টিক সেন্টার প্রায় ছয়গুণ, মোট বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা মোট ১৭৭১৮টি। সরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে ৫২৮০৭টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১০৫১৮৩টি।
প্রিজম নামক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঢাকায় ১২০০টি হাসপাতালের সাথে চুক্তিবদ্ধ। করোনার আগে এ সংস্থা প্রতিদিন ১৪ টন বর্জ্য সংগ্রহ করতো। গড়ে প্রতিটি হাসপাতাল থেকে ১১ দশমিক ৭ কেজি। বর্তমানে প্রতিদিন ৭-৮ টন বর্জ্য সংগ্রহ করছে। অথচ একটি হিসাব মতে ঢাকায় দৈনিক নূনতম ২০৬ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব তথ্য তুলে ধরে হাসপাতালগুলো তাদের বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করছে না বলে অভিযোগ করা হয় এই সমাবেশ থেকে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান -এর সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক এম এ ওয়াহেদের সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, নাসফ-এর সাধারণ সম্পাদক মো. তৈয়ব আলী, সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা কে এম সিদ্দিক আলী, সহ-সভাপতি অলিভা পারভীন, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটির নিবার্হী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ’র সভাপতি নাজিম উদ্দীন, বিডিক্লিক’র সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটির সদস্য সচিব মেনন চৌধুরী, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশননের মুখপাত্র মো. ইমরান হোসাইন, আলোকিত বন্ধু সংঘ’র সাধারন সম্পাদক মো. রনি, হিলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জেবুন্নেসা, সুবন্ধনের সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান, মৃত্তিকা’র খাদিজা খাতুন, গ্রিণফোর্স’র আহসান হাবিব, ক্যামেলিয়া চৌধুরী, শাকিল রেহমান, কবি কামরুজ্জামান ভূইয়াসহ অনেকেই।
এই মানববন্ধন থেকে যেসব দাবি তুলে ধরা হয়েছে—
১. মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে বর্জ্যসমূহ উৎসেই যথাযথভাবে পৃথক করে সঠিকভাবে ডিস্পোজাল করতে হবে। এখানে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করলেও, দায় থাকবে বর্জ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানেরই।
২. স্বাস্থ্য শিক্ষার সব শাখায় বিশেষ করে এমবিবিএস, নার্স এবং মিডওয়াইফ কারিকুলামে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা ও হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. স্বাস্থ্য বাজেটে মেডিকেল বর্জ্যের নিরাপদ নিষ্কাশনের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
৪. পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সম্পৃক্ত করে এবং জনস্বাস্থ্যসহ পরিবেশ বিপর্যয়কে গুরুত্ব দিয়ে মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ সংশোধন করতে হবে।
৫.সকল মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার লক্ষে ক্ষতিকারক সকল উপাদানসমূহ চিহ্নিত করে তা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে গবেষণার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সারাবাংলা/আরএফ/
পবা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন মেডিকেল বর্জ্য মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা