ঝুঁকিপূর্ণ বলেই ঢাবিতে কৃষ্ণচূড়ার গোড়ায় কুড়ালের আঘাত
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:১৪
ঢাকা: সম্প্রতি কাটা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন-সংলগ্ন একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। প্রবীণ একটি বৃক্ষ এভাবে কেটে ফেলা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। প্রতিবাদে গাছটির গুঁড়ি কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে মিছিল করাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বয়সের কারণে হেলে পড়া গাছটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। জীবনহানির শঙ্কা থেকেই গাছটি কেটে ফেলতে হয়েছে। একই বিবেচনায় কাটা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দু’টি ইউক্যালিপটাস গাছও।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে গাছটি কেটে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বৃক্ষরোপণ ও সৌন্দর্যবর্ধন নিয়ে কাজ করা আরবরি কালচার সেন্টার সূত্র জানাচ্ছে, প্রায় অর্ধ শতক বয়সের বেশি সময় ধরে কৃষ্ণচূড়া গাছটি দাঁড়িয়ে ছিল কলাভবনের পূর্ব পাশে প্রক্টর অফিস ও ক্যাফেটেরিয়া-সংলগ্ন জায়গাটিতে। বয়সের কারণেই গাছটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
গাছ কাটা প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা দেখেছি, কৃষ্ণচূড়া গাছটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। গাছটি অনেকটা হেলেও পড়েছিল। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই গাছটি কাটা হয়েছে।’
গাছ উপড়ে পড়ার ঘটনা ঢাবিতে নতুন নয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঝড়ে গাছ উপড়ে পড়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। এর আগে, ২০১৬ সালের পহেলা মে কালবৈশাখী ঝড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে একটি বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ রাস্তায় উপড়ে পড়ে। ২০১৭ সালে গ্রন্থাগারের সামনে থাকা শতবর্ষী নিমগাছটিও ঝড়ের কবলে পড়ে উপড়ে যায়। কেবল ২০১৭ সালেই ঝড়ের কবলে পড়ে সূর্যসেন হলের সামনে দু’টি, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দু’টি, মুহসীন হলের ভেতরে একটি ও কলাভবনের সামনে দু’টি গাছ উপড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনায় হতাহতের রেকর্ড না থাকলেও ২০১৯ সালে দোয়েল চত্বর সংলগ্ন জায়গায় চলন্ত রিকশার ওপর নারকেল গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনায় প্রাণ হারান একজন।
শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ
কৃষ্ণচূড়া গাছ কাটার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ। কাটা গাছের একটি গুঁড়ি কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল বের করে সংগঠনটি। ‘কৃষ্ণচূড়া হত্যার প্রতিবাদ’ শীর্ষক প্রতিবাদ মিছিল শেষে কাফনের কাপড়ে মোড়ানো গাছের গুঁড়িটি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের বাসভবনের সামনে রেখে আসেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
গাছ কাটার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে ক্ষোভ আর প্রতিবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শাদাব নূর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সুন্দর কিছু ধ্বংস করতে কতটা হৃদয়হীন হতে হয়? এই কাজের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করলাম। মাত্র কয়েক হাজার টাকার জন্য যারা এসব করে, তারা ক্যাম্পাসের শত্রু। যারা একবার হলেও এই গাছের অক্সিজেন ফুসফুসে নিয়েছেন, প্রিয় মানুষ আর বন্ধুদের সঙ্গে এই গাছের ফুলের ছবি বিনিময় করেছেন— এই কাজটার প্রতিবাদ না করলে আপনি সৌন্দর্যপ্রেমী নন, শুধুই একজন সুবিধাবাদী।’
শাদাব নূরের মতো ফেসবুকে প্রতিবাদমুখর অনেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ এই ইস্যুতে সরব। কেউ কেউ অবশ্য ঝুঁকি বিবেচনায় গাছ কাটার সিদ্ধান্তের পক্ষেও মুখ খুলেছেন।
আরবরি কালচার সেন্টার যা বলছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবরি কালচার সেন্টারের বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা। তার দাবি, কৃষ্ণচূড়া গাছ সাধারণত সফট উড বা নরম কাঠের গাছ হয়ে থাকে। এগুলো যেকোনো সময় হেলে পড়তে পারে।
ড. মিহির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি কেন একটি সুস্থ গাছ কেটে ফেলব? তা হলে আমি কী পড়ালেখা করলাম? যখন দেখি মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়, তখন গাছের জীবনের প্রতি একটু নির্দয় হতেই হয়, কেটে ফেলার সিদ্ধান্তও নিতে হয়।’
কৃষ্ণচূড়া গাছটির সঙ্গে কলাভবনের দেয়ালের দূরত্ব ছিল দুই থেকে তিন মিটার। ৪৫ ডিগ্রি কোণে হেলে পড়া এই গাছটির শিকড় ভবনের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি ছিল দাবি করে অধ্যাপক মিহির লাল বলেন, ‘গাছটির বয়স হয়েছিল অনেক। এরমধ্যেই ৪৫ ডিগ্রি কোণে হেলেও পড়েছিল সেটি। পাশেই ছিল কলাভবনের দেয়াল। গাছের শেকড়গুলো দেয়াল পর্যন্ত গিয়ে ভবনের ক্ষতি হওয়ার একটা ঝুঁকিও ছিল।’
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন এই অধ্যাপক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা গাছ কাটা নিয়ে কথা বলছে, তারা আমাদের কাছে এসে বন্ড সই করে যাক— এরপর থেকে গাছ পড়ে যদি কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী আহত হন, এর সব দায়দায়িত্ব তারা নেবেন। আমি একটি গাছও কাটব না। প্রাণহানির ঝুঁকি না থাকলে কেন শুধু শুধু গাছ কাটতে যাব!’
কৃষ্ণচূড়া গাছ কাটার পাশাপাশি আরও দু’টি ইউক্যালিপটাস গাছ কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিদেশি প্রজাতির এই গাছ পরিবেশবান্ধব নয় বলে দাবি করেন অনেকেই। তবে অধ্যাপক মিহির লাল সাহার দাবি, এই গাছ পরিবেশের পক্ষে হানিকারক নয়। যে দু’টি ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, সেগুলোও ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা বিবেচনায় কাটা হয়েছে।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ইউক্যালিপটাস গাছ খুব দ্রুত বড় হয়। অনেকেই এই গাছ পরিবেশবান্ধব নয় বলেন। অনেক পানি শোষণ করে বলে তারা মূলত এই দাবি করে থাকেন। কিন্তু এই গাছের তেল অনেক দামি এবং ইনসেক্ট রিপেলেন্ট (পোকামাকড় দূরে সরিয়ে দেয়) একটি গাছ। গাছের যে গন্ধ, তাতে পোকামাকড় সাধারণত গাছের কাছে আসে না। ভালোই তো আছে। আর যে দু’টি ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, সেগুলোর গোড়া ক্ষয়ে গিয়েছিল। হেলে পড়ার ঝুঁকি থাকায় সেগুলো কাটা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব নয়, এ কারণে কাটা হয়নি।’
বেশি বেশি গাছ লাগানোর দাবি
এদিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ কাটার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত কফিন মিছিল থেকে ক্যাম্পাসে আরও ১০০ গাছ রোপণ করার দাবি জানান ছাত্র ইউনিয়েনের নেতারা। এমন দাবি রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনজুরুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে যুক্তি দেখিয়ে গাছ কাটছে, এটি সমর্থনযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন এই গাছগুলো কাটার পর আরও বেশি বৃক্ষরোপণে মনোযোগী হয়, সে ব্যাপারে আমরা সোচ্চার হতে পারি।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘নতুন করে আরও গাছ লাগানোর ব্যাপারে সবার সোচ্চার হওয়া উচিত। ঝুঁকির কারণে গাছ যদি কাটতেই হয়, তবে যেন আরও বেশি বেশি গাছ লাগানো হয়— প্রশাসনকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
ক্যাম্পাসে বৃক্ষায়ন প্রসঙ্গে আরবরি কালচার সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন জায়গাটা আমরা ফাঁকা রেখেছি? আমাদের দেখানো হোক! মানুষের ধারণা— গাছ কাটা হলেও আমরা গাছ লাগাই না। এই ধারণা ঠিক নয়।’
সারাবাংলা/আরআইআর/একে