জেলা প্রশাসন বনাম আইনজীবী সমিতি, মাঝে ‘পরীর পাহাড়’
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:৫৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে একটি পাহাড়ের ‘আধিপত্য’ নিয়ে চলা জেলা প্রশাসন ও জেলা আইনজীবী সমিতির বিরোধ সম্প্রতি চরম আকার ধারণ করেছে। একই পাহাড়ে রয়েছে আদালত ভবন, জেলা আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন স্থাপনা এবং বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।
বিরোধের জেরে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে আইনজীবী সমিতি ও জেলা প্রশাসন। রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) বেলা ১২টায় জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘জঘন্য মিথ্যাচার’র অভিযোগ তোলা হয়। অন্যদিকে আইনজীবীদের সংবাদ সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা অবস্থান নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
চট্টগ্রাম নগরীর কেন্দ্রে লালদিঘীর পাড়ের দক্ষিণে ‘পরীর পাহাড়’। সেই পাহাড়ে আদালত সংলগ্ন এলাকায় জেলা আইনজীবী সমিতি আইনজীবীদের চেম্বারের জন্য নতুন দু’টি ভবন নির্মাণেরর উদ্যোগ নিলে আপত্তি তোলে জেলা প্রশাসন। সমিতির ওই দুই নতুন স্থাপনা নির্মাণকে জেলা প্রশাসন বলছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। আর সমিতির দাবি, নিয়ম মেনে ‘অনুমোদন’ নিয়েই তারা ভবন করছেন। ইতোমধ্যে পরীর পাহাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করতে এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তাতে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জেলা আইনজীবী সমিতি। সংগঠনের সভাপতি এনামুল হকের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সমিতির সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম, বদরুল আনোয়ার, শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনতোষ বড়ুয়া, মুজিবুল হক, আব্দুর রশিদ এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ১৮৯৩ সালে নির্মিত পুরাতন আদালত ভবনেই সমিতির কার্যালয় ছিল। সেসময় সেখানে বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসকের কোনো কার্যালয় ছিল না। আইয়ুব খানের আমলে সেখানে অস্থায়ী অফিস শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে স্থায়ী লিজ দলিল মূলে সরকারি খাস জমি সমিতিকে হস্তান্তর করা হয়। ‘আইনজীবী সমিতি ভবন’ নির্মাণের পর খালি জমি আবার স্ট্যাম্প ভেন্ডর সমিতিকে জেলা প্রশাসন লিজ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে স্বত্ত্ব ঘোষণার মামলা করে সমিতি।
২০০৪ সালে লিজ পাওয়া জমির চৌহদ্দি নির্ধারণ করে সমিতির পক্ষে রায় দেন আদালত। এরপর ওই জমিতে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে করা মামলায়ও নিষেধাজ্ঞার আদেশ পায় সমিতি। ২০১৪ সালে সে সময়ের জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে সমিতির জমির সীমানা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। অতীতে বিভিন্ন সময় কোর্ট হিল নিয়ে জেলা প্রশাসন ‘একনায়কতন্ত্র ও দখলদারিত্ব’ দেখালে আইনজীবীরা প্রতিবাদসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, সমিতির ভবনগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আইন মন্ত্রণালয়ের অনুদানে এবং সমিতির নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। ভবন নির্মাণে বিভিন্ন দফায় প্রধানমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান দেওয়া হয়। সমিতির কোনো ভবন অবৈধ হলে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় অনুদান দিত না।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ভবনগুলো সিডিএ থেকে যথাযথভাবে অনুমোদিত। সিডিএ থেকে জেলা প্রশাসনকে পত্র মারফতে ইতোপূর্বে বিষয়টি জানানো হয়েছে এবং পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ভবনগুলো নির্মাণের সময় কোনো পাহাড় টিলা কাটা হয়নি। পাহাড়ের ঢালু রক্ষা করে অর্থাৎ পাহাড়ের আকৃতি, প্রকৃতি বিনিষ্ট না করে ধাপে ধাপে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়। যদি পাহাড় টিলা কাটা হতো তবে নিশ্চয় সেসময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধা দিত। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের সমিতির যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তা বিনষ্টের অসৎ উদ্দেশ্যে অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন।’
সাম্প্রতিক বিরোধ প্রসঙ্গে জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘জেলা প্রশাসক সিডিএকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, পরীর পাহাড়ে ভবনের অনুমোদন দেওয়ার আগে জেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগ না দিতেও সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়েছেন তিনি, যা উনার এখতিয়ার নয়। মূলত নতুন দুই ভবন নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে এই ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপ। পরীর পাহাড়ে আইনজীবী সমিতির কোনো অবৈধ স্থাপনা নেই। পরীর পাহাড়ে দোকান, হোটেল, হকার ও বস্তির জমির লিজ জেলা প্রশাসন দিয়েছে। যা থেকে জেলা প্রশাসন দৈনিক ও মাসিক ভাড়া তোলে। তদন্ত হলে বের হবে, এসব স্থাপনা কার আর ভাড়া কে নেয়।’
এছাড়া পরীর পাহাড়ে পার্কিং নির্মাণে বিরোধিতা, সিসি ক্যামরা স্থাপনে বাধা ও পুরাতন আদালত ভবনে দুটি কক্ষ দখল বিষয়ে আইনজীবী সমিতির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ জেলা প্রশাসন থেকে করা হয়েছে তা মিথ্যা বলে দাবি করেন সমিতির নেতারা।
সমিতির সভাপতি এনামুল হক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখেছি জেলা প্রশাসক একটি গোপন প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দিয়েছেন। সেখানে সব বক্তব্য মিথ্যাচার। প্রতিবেদনে বলেছেন, আমাদের ভবনগুলো অবৈধ। অথচ সিডিএ বলেছে সেগুলো অনুমোদিত। প্রতিবেদনে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় অননুমোদিত ৩৫৩টি অবৈধ স্থাপনার কথা আছে। সেগুলো থেকে জেলা প্রশাসন নিয়মিত ভাড়া নেয়। প্রতিবেদনে নতুন ভবনে চেম্বার বরাদ্দের জন্য ১২ কোটি টাকা আদায়ের যে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত একটি টাকাও সংগ্রহ করা হয়নি।’
জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইনি পথে যাবার ইঙ্গিত দিয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সম্মান ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আইনজীবী সমাজ সংঘাতে বিশ্বাস করে না বলেই জেলা প্রশাসনের সব অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবসময় আইনি পথে হেঁটেছে। জেলা প্রশাসক বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেলা আইনজীবী সমিতির নামে যে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন, অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করে সমিতির কাছে উনার ক্ষমা চাওয়া উচিত। অপপ্রচার চালিয়ে সমিতির বিরুদ্ধে যে জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার না করলে অনতিবিলম্বে আইনি ব্যবস্থার পথে হাঁটব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের এখতিয়ার বর্হিভূত কর্মকাণ্ড এবং মিথ্যাচার অব্যাহত থাকলে উনার (জেলা প্রশাসক) অপসারণ চাইতে বাধ্য হব।’
জেলা প্রশাসনের অবস্থান
এদিকে জেলা আইনজীবী সমিতির সংবাদ সম্মেলনের পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দীর্ঘ বক্তব্য ও তথ্য-উপাত্ত পাঠানো হয়েছে গণমাধ্যমে। জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক এসব তথ্য-উপাত্ত পাঠিয়েছেন।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পরীর পাহাড়ে ১২ দশমিক ৯০ শতক জমির ওপর আইনজীবী সমিতির মালিকানা থাকলেও লিজ পাওয়া পর গত ৪৪ বছরে তারা রেকর্ড-খতিয়ান তৈরি করেনি। এমনকি কোনো ভূমি উন্নয়ন করও দেয়নি। আইনজীবী সমিতি তাদের লিজ পাওয়া ভূমি নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে গত ৪৪ বছরে খতিয়ান ও খাজনার রসিদ সামনে আনেনি বলে দাবি জেলা প্রশাসনের।
লিজ পাওয়ার পর থেকে জেলা আইনজীবী সমিতি বারবার লিজ দলিলের শর্তও ভঙ্গ করেছে বলে দাবি জেলা প্রশাসনের। তাদের বক্তব্য, লিজ দলিলের ১১ নম্বর শর্তানুযায়ী লিজকৃত ভূমিতে স্থাপনা নির্মাণে জেলা প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন হলেও তারা কখনোই সেটি নেয়নি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রথম শ্রেণির কেপিআইভুক্ত। আইনজীবী সমিতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবনের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে তাদের ভবনগুলো তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে কেপিআই নীতিমালা লঙ্ঘন হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের দাবি, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আইনজীবী সমিতির ভবন নির্মাণে ত্রুটি আছে। ভবনগুলোর পেছনের অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমানা প্রাচীরেও ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলে মানবিক বিপর্যয় হবে। তাদের পাঁচটি ভবন যেভাবে একটির সঙ্গে লাগোয়াভাবে আরেকটি গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে আগুন লাগলে শত শত মানুষের প্রাণহানি হবে।
এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্থাপনা গড়তে হলে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু আইনজীবী সমিতি ট্রাস্টের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো অনুমতি না নিয়েই ভবন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করেছে। উল্লেখ্য, আইনজীবী সমিতি সম্প্রতি যে দু’টি ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তার একটি বঙ্গবন্ধুর নামে হবে বলে তারা জানিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘পরীর পাহাড় নিয়ে কী করতে হবে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে আমি নির্দেশনা পালন করব। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী আইন মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় পরিবেশসহ অন্যান্য সংস্থাকে নিয়ে কাজ করবে। আমি যেহেতু সরকারি চাকরি করি, কে কী মন্তব্য করেছেন, সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি কোনোকিছু বলতে চাই না। উসকানিমূলক মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অন্য কোনো কাউন্টার মন্তব্য আমি করতে পারি না।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
আইনজীবী সমিতি আব্বাস মিয়া ও সাদা পরীর গল্প জেলা প্রশাসন টপ নিউজ পরীর পাহাড়