মহামারি বাস্তবতা মেনে নিয়েই শিশুদের স্কুলে পাঠানোর পরামর্শ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৫:৩০
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর এক সপ্তাহ পেরিয়েও গেছে। সরকারসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হচ্ছে। তারপরও অনেক অভিভাবকই এখনো সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক অভিভাবককেই সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ব্যপারে অনীহা প্রকাশ করতে দেখে গেছে।
অভিভাবকরা বলছেন, সন্তানদের স্কুলে না পাঠানোর পক্ষে তাদের কেউই নন। তবে শিশুদের ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় শিশুদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে নির্দেশনা না মানার আশঙ্কা কাজ করছে তাদের মধ্যে। সে কারণেই তাদের কেউ কেউ সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে একটু সময় নিতে চান।
অভিভাবকদের এমন শঙ্কা-উদ্বেগ আমলে নিয়েই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করতে পারলে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে। তাছাড়া শিশুরা স্কুলে গেলে সেটি তাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশে রাখবে ইতিবাচক ভূমিকা। মহামারি পরিস্থিতি মেনে নিয়েই নতুন ধরনের বাস্তবতা মেনে নিয়েই সবাইকে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
নাখালপাড়ার বাসিন্দা তরিকুর রহমানের সাত বছর বয়সী সন্তান তেজগাঁও এলাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হলেও স্বাস্থ্যবিধি কতটা অনুসরণ হবে, সেটি নিয়ে সংশয় থাকায় সন্তানকে এখনই স্কুলে পাঠাচ্ছেন না তিনি। বলছেন, সরকারি স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে— এ বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারলে সন্তানকে পাঠাতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। জানালেন, তারপরও হয়তো বাধ্য হয়েই সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন, তবে আরও কিছুদিন পর।
স্কুল খোলার পর থেকে মেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন অভিভাবক প্রতীক মাহমুদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে প্রথার বয়স ৫ বছর। নার্সারিতে পড়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি শুরুর পর থেকেই ঘরবন্দি। আগে স্কুলে যেত না। এ বছরের শুরুতেই একটি স্কুলে ভর্তি করে দিই। তখন থেকেই অনলাইনেই ক্লাস করছিল। এখন সপ্তাহে এক দিন করে স্কুলে যায়। আর দুই দিন করে ক্লাস হয় অনলাইনে।’
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য স্কুলে যাওয়াটা জরুরি বলে মনে করেন প্রতীক মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘গত বছর আমিসহ পরিবারের সবাই দুই বার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হই। তারপর থেকেই মেয়ের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করি। সে প্রায়ই বাইরে যেতে চায়। জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে প্রায়ই অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। কোনো কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে নিয়ে গেলে পরের দুয়েকদিন সে বেশ প্রফুল্ল থাকে। সেজন্য স্কুল খোলা এবং ক্লাসে যাওয়াটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছি।’
উত্তরার বাসিন্দা হাসিবা রহমানের মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ১২ সেপ্টেম্বর থেকেই সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। হাসিবা বলেন, মেয়ে মাস্ক পরে স্কুলে যাচ্ছে। গেটে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নিচ্ছে। ক্লাসরুমে বসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে একটু দূরে দূরে। এই ব্যবস্থাগুলো কিছুদিন গেলে ঠিকঠাক থাকবে কি না, সেটিই প্রশ্ন। তাছাড়া তবে পঞ্চম শ্রেণি বলে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিন দিয়ে শুরু করতে পারত সরকার। পরে পরিস্থিতি বুঝে প্রতিদিন ক্লাস করানোর ব্যবস্থা করানো যেত।
এই অভিভাবক বলেন, আমরা সন্তানদের স্কুলে দিতেই চাই। কারণ অনলাইনে ক্লাস চললেও স্কুলের পড়ালেখার বিকল্প অনলাইন হতে পারে না। কিন্তু সন্তানের সুরক্ষার দিকটাতে আগে নজর দিতে হবে। প্রতিটি স্কুলে আইসোলেশন সেন্টার ও জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। শুধু করোনা নয়, ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মশা নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে। তার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন দেওয়া ভ্যাকসিন যেন শিশুরা পায়, সেটি দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করতে হবে।
সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে অভিভাবকদের এমন দ্যোদুল্যমানতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, অনেকদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও স্কুল সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের ‘মোশন ইনারশিয়া’ কাজ করছে। থেমে থাকা অবস্থা থেকে হঠাৎ করে চলতে শুরু করলে এরকম প্রবণতা কাজ করে। তাছাড়া অনেক অভিভাবকের মধ্যেই সন্তানদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কাজ করছে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না। অভিভাবকদের অনীহার পেছনে এসব বিষয় কাজ করছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা সংক্রমণের ৩ শতাংশের বয়স ১০ বছরের কম। অন্যদিকে ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার মোট সংক্রমণের ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার মোট সংক্রমণের প্রায় ১০ শতাংশ। ফলে সন্তানদের করোনা সংক্রমণ নিয়ে অভিভাবকদের যে আশঙ্কা, সেটিকেও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন এই মনোস্বাস্থ্যবিদ।
শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের শঙ্কা বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভাইরোলজিস্ট সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, শিশুদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার হার খুব একটা কম নয়। তবে তাদের শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হার কম। অন্যদিকে তাদের মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে সামগ্রিকভাবে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকছে। সেটি যদি না বাড়ে তাহলে অভিভাবকরা হয়তো সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।
শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ইতিবাচক একটি দিকও তুলে ধরলেন ডা. জাহিদুর। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, সুস্থ-স্বাভাবিক শিশু-কিশোরদের প্রতিরোধক্ষমতা বেশি ও কো-মরবিডিটির পরিমাণ কম থাকায় করোনার প্রভাব তাদের ওপর তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও তাদের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই স্কুলে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সকালের রোদের সংস্পর্শ থেকে ভিটামিন ডি পাবে শিশুরা। শারীরিক কার্যক্রমের মধ্যে চলে আসায় প্রতিরোধক্ষমতা আরও বাড়বে। তবে আবারও বলছি, ঘর থেকে শুরু করে স্কুল পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যবিধির প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে এবং সেটি কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও মনিটরিং প্রসঙ্গেই অভিভাবকদের উৎকণ্ঠাকে যৌক্তিক মনে করছেন শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ আঞ্জুমান পারভীন অভি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে যেসব স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, তা অনেকেই ঠিকমতো জানেন না। কতক্ষণ পরপর হাত ধুতে হবে বা স্যানিটাইজ করতে হবে, তার নির্দিষ্ট গাইডলাইন কি আমরা জানি? ক্লাসরুমের আকার অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ফাঁকা ফাঁকাভাবে বসার সুযোগ আছে কি না— এই প্রশ্নও থেকে যায়। ফলে অভিভাবকদের অনীহা অযৌক্তিক নয়।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইউনিসেফের গাইডলাইন অনুসরণ করে অভিভাবকদের সেই গাইডলাইন বিতরণ করলে সেটি পরিস্থিতিকে সহজ করতে ভূমিক রাখতে পারে বলে মনে করেন আঞ্জুমান পারভীন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ভয়ও থাকা উচিত। এতে সবাই সতর্ক থাকবে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। তবে ভীতি দূর করে অনলাইন ও অফলাইনের সমন্বয় করতে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমাধানে আসতে হবে।
ইউনিসেফের গাইডলাইন অনুসরণের তাগিদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়েছে। কিন্তু স্কুল-কলেজ বছরের পর বছর বন্ধ থাকতে পারে না। আমার মতে আরও আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা উচিত ছিল। সমাজে এখনো শিক্ষকদের কথা অনেকেই শোনেন। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরিতে কাজে লাগানো যেত। তাছাড়া ঘরে থাকলেই যে শিশুরা নিরাপদ, সেটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না। স্কুল-কলেজে গেলে বরং শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। তাই সবাইকে ইউনিসেফের গাইডলাইন মেনে স্কুলে-কলেজে যেতে হবে। তবে অভিভাবকদের ভিড় করা যাবে না।
মহামারিতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন-অফলাইন সমন্বয়ের বিষয়টিও আত্মস্থ করার পরামর্শ দিলেন মনোবিদ ড. হেলাল উদ্দীন। তিনি বলেন, মহামারিতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি ও শিখন ঘাটতি দেখা গেছে। পাশাপাশি এটিও মনে রাখতে হবে— মহামারিও কিন্তু একটি শিক্ষা। এই সময়ে ঘরে থেকেই শিশুরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা পেয়েছে। এটি জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মহামারির এই শিক্ষা তাদের জীবনের বাকি দিকগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে। তাছাড়া বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে জীবন আবার আগের মতো হয়ে যাবে তা না। কিছু পরিবর্তন আসবেই।
শিক্ষাব্যবস্থাও বদলে যাবে। অনলাইন-অফলাইন দুই পদ্ধতিই চালু থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাই সবকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েই শিখতে হবে— এমনটি ভেবে বসে থাকলে চলবে না।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী স্কুল