কারাগারে মাদক মেলে যেভাবে
৪ এপ্রিল ২০১৮ ১০:১৫ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৮ ১৯:৩৮
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: মাদক। তিন অক্ষরের এ নামটির ব্যপ্তি কোথায় নেই? বস্তি থেকে বার, আর থানা থেকে কারাগার কোথায় মেলে না এ নেশা জাতীয় দ্রব্যটি? মাদকের ব্যবসা কিংবা ব্যবহারের দায়ে যাকে নেওয়া হচ্ছে কারাগারে সেই অপরাধীও সেখানে দেদারছে মাদক সেবনের সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু কোথায় পাচ্ছে মাদক? ‘নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা’র ফাঁক গলে কারাগারে কি করে পৌঁছাচ্ছে তা? সারাবাংলার অনুসন্ধান আর কারা কর্তৃপক্ষের সহজ স্বীকারে বেরিয়ে আসছে সেসব তথ্য।
কারাসূত্রে জানা গেছে, দেশের কারাবন্দীদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগই মাদকের মামলার আসামি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হাজতি। এদের কেউ মাদকাসক্ত, কেউ বিক্রেতা আবার কেউ ক্রেতা। এরা ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক মামলার আসামি।
কারাগার থেকে বেরিয়ে বেশ কয়েকজন মাদক মামলার আসামির সঙ্গে সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের কথা হয়। একান্ত সে আলাপচারিতায় তারা জানান, কারাগারে তাদের কাছে মাদক পৌঁছে মূলত কারারক্ষী ও কারা পুলিশের মাধ্যমে।
কি করে সম্ভব? এমন প্রশ্নে মাদকাসক্ত (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন) আশিকুর নয়ন বলেন, ‘বাসা থেকে খাবার পাঠাতেন পিসির (জেলে টাকা পাঠানোর মাধ্যম) মাধ্যমে। ওইসব খাবার যেমন আপেল, কলা, গুড়, চিরা-মুড়ি, কমলার ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিত। যিনি দায়িত্বে থাকতেন তিনি টের পেতেন না। আর যদি কখনো টের পেতেন, টাকা দিলে আর মুখ খুলতেন না। শুধু বলতেন,‘তোমাকে পরিবার যে খাবার দিয়েছে তা অন্য কাউকে দিও না। অন্যরা জানলে সবার বিপদ হবে। কেননা কারাগারে মাদক নিষিদ্ধ।’
ঢাকার বাইরে একটি কারাগারে ছিলেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তার পাশে একজন ইয়াবা আসক্ত ছিলেন। তার সিগারেটের প্যাকেট যখন প্রবেশ করত, সেই প্যাকেটের দুই চারটি সিগারেটের তামাক বের করে ফেলে সেখানে ইয়াবা দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিত। আর সিগারেট প্রবেশে তো বাধা নেই। রাতের বেলায় কয়েকজন মিলে সেই ইয়াবা সেবন করত। পরদিন সারাদিন ঘুমাত। কারাগারে এমনও আসামি আছেন, যাদের নামে আসা মালপত্র কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা ভোগ করে কিছু অসাধু কারারক্ষী।
জামিনে বেরিয়ে আসা কারাবন্দীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ঢাকার বাইরের কিছু কিছু কারাগারে রান্না করা খাবারও ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। তবে তা বিশেষ ব্যবস্থায়। ওই খাবারের সঙ্গে বিশেষ করে পোলাও, ডিম, মাছ ভাজির সাথে ইয়াবা ও গাঁজা পলিথিনে প্যাকেট করে পাঠানো হয়।
কারাগারে মাদকের বিস্তার ও সরবরাহ প্রসঙ্গে, কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেন, কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও কারাগারের ভেতরে মাদক ঢুকছে। মাদক সরবরাহ বন্ধে প্রবেশ পথে লাগেজ ও বডি স্ক্যানার বসানো হচ্ছে। কাজটি করা হলে মাদক সরবরাহ বন্ধ হবে।
তিনি বলেন, বন্দিরা কারাগারে মাদক পাচ্ছে। লুঙ্গি ও শার্টের সেলাইয়ের ভাঁজের ভেতরে, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, টুথপেস্ট, আপেল ও সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরে যাচ্ছে ইয়াবা। এছাড়া খাবারের ভেতরেও গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক কারাগারে যাচ্ছে। আর এসব কাজে কারারক্ষীদের একটা অংশ সহায়তা করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, কারারক্ষীদের অনেকে মাদক ভেতরে প্রবেশে সহায়তা করে থাকেন। তাদের চিহ্নিত করে গত এক বছরে ২০ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকিদের বিচার চলছে।
কারাগারের ভেতরে মাদক গ্রহণ করছে কিভাবে? সেখানে তো কড়া নিরাপত্তা থাকার কথা, এমন প্রশ্নে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, কারাগার ও বন্দীদের তুলনায় কারারক্ষীর সংখ্যা অনেক কম। দেখা যাচ্ছে যে, একটা লকাব দেখাশোনা করার জন্য ভেতরে ও বাইরে কয়েকজন কারারক্ষী দরকার। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে সেখানে একজন কারারক্ষী দিয়েই চালাতে হচ্ছে। ফলে বন্দীরা কখন কি করছে তা টের পাচ্ছেন না।
এরপরও আগের চেয়ে সবদিক থেকেই উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ জেল কোড আইনটি হয়ে গেলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। কারারক্ষীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি হলে কারাগারের ভেতরে মাদক প্রতিরোধেও অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে।
সারাবাংলা/ইউজে/এমএস/আইএ