Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উচ্চশব্দ কেড়ে নিচ্ছে শ্রবণশক্তি, শব্দদূষণে নাকাল চট্টগ্রামবাসী

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:৫৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নাক, কান, গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোস্তফা মাহফুজুল আনোয়ার হাসপাতাল এবং ব্যক্তিগত চেম্বার মিলিয়ে দিনে প্রায় শ’খানেক রোগীকে চিকিৎসা দেন। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশই শ্রবণশক্তি হ্রাস ও স্থায়ীভাবে নষ্ট হওয়ার উচ্চঝুঁকিতে থাকা রোগী। এই চিকিৎসকের মতে, এদের বেশির ভাগই শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে সড়কে শব্দদূষণের শিকার। শব্দদূষণ ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকায় গত পাঁচবছরে এ ধরনের রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম নগরী এবং আশপাশের জেলা-উপজেলার বাসিন্দাদের বড় অংশ স্থায়ীভাবে শ্রবণজনিত নানা প্রতিবন্ধকতায় ভুগবেন বলে আশঙ্কা চট্টগ্রামের বধির শিশু কল্যাণ সমিতির (সাহিক) চিকিৎসক সুমন তালুকদারের। আর শিশুরা এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি শিকার হবে বলে মত এই চিকিৎসকের।

পরিবেশ অধিদফতরের অধীনে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্পের’ আওতায় সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় শব্দদূষণ জরিপ করা হয়। এতে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর ৩০টি স্পটে শব্দদূষণের মাত্রা দ্বিগুণের কাছাকাছি। হাসপাতালের সামনের এলাকা-সড়কও দূষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অথচ ২০০৬ সালের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুযায়ী, কোথাও কোনো হাসপাতাল থাকলে সেটি ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর ‘নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোনো প্রকার হর্ন বাজানো যাবে না’।

চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মতে, যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন, নির্মাণ কাজের শব্দ, মাইন্ড-সাউন্ডবক্সের উচ্চ আওয়াজ, ট্রেনের হুইসেল, অনিয়ন্ত্রিত মোটরসাইকেল— এসব কারণে শব্দদূষণ বাড়ছে। আর চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যেসব শ্রবণ সমস্যাজনিত রোগী তারা পাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই হাইড্রোলিক হর্নের শিকার।

চলতি বছরের ২২ আগস্ট পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালিত এক পরীক্ষায় চট্টগ্রাম নগরীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, জেমিসন রেডক্রিস্টে হাসপাতাল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিক, এ কে খানে আল আমিন হসপিটাল, পাঁচলাইশে সার্জিস্কোপ হসপিটাল, মুরাদপুরে একুশে হসপিটাল, মেহেদিবাগে ম্যাক্স হাসপাতাল, পূর্ব নাসিরাবাদে সাউদার্ণ হাসপাতাল এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ৬৬ দশমিক ৫ ডেসিবল থেকে ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবল পর্যন্ত। অথচ বিধিমালা অনুযায়ী, এসব এলাকা ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার কথা ছিল। মানমাত্রা অনুযায়ী সেখানে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা থাকার কথা ৪৫ ডেসিবলের মধ্যে।

চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততম ও জনবহুল মোড়গুলোতে দূষণের মাত্রা আরও মারাত্মক। পরীক্ষায় দেখা গেছে, নগরীর এ কে খান মোড়, জিইসি, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, সিইপিজেড, অক্সিজেন মোড়ে শব্দের মাত্রা ৭৭ দশমিক ৫০ ডেসিবল থেকে ৯৭ দশমিক ৫০ ডেসিবলের মধ্যে। অথচ সেখানে নির্ধারিত শব্দের মানমাত্রা হচ্ছে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে।

শব্দদূষণ চলছে চট্টগ্রাম নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোতেও। চান্দগাঁও, আমিরবাগ, হালিশহর কে-ব্লক, কল্পলোক, হিলভিউ, কসমোপলিটন, খুলশী দক্ষিণ আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৬৭ ডেসিবল থেকে ৭৮ দশমিক ৫ ডেসিবলের মধ্যে। সেখানে শব্দের মানমাত্রা সর্বোচ্চ ৫০ ডেসিবল।

চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি এবং ২২ জুন আরও দুইদফায় একইভাবে চট্টগ্রাম নগরীর ৩০টি স্পটে শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তখনও শব্দের মাত্রা ছিল নির্দিষ্ট মানমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। যদিও জুনে মাত্রা কিছুটা কম ছিল। সেটা করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় ঘোষিত লকডাউনের কারণে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর শব্দদূষণের হারও বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম মহানগরীতে শব্দ দূষণের মাত্রা বেড়েছে। ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ, ১৪ মে এবং ১৩ আগস্ট তিনদফায় নগরীর ১২টি স্পটে শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছিল। স্পটগুলো হচ্ছে- এ কে খান মোড়, জিইসি, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, সিইপিজেড মোড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় বিএসআরএম কারখানার সামনে, সাগরিকা শিল্প এলাকায় বিডি সী ফুড কারখানার সামনে, অলঙ্কার বাসস্ট্যান্ড, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা এবং ও আর নিজাম সড়ক। এসব স্পটে চারবছর আগে শব্দের যে মাত্রা পাওয়া গিয়েছিল, ২০২১ সালে এসে শব্দের মাত্রা আরও বেড়েছে।

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট ‘স্বাস্থ্যে শব্দের প্রভাব’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, আচমকা শব্দে (ইমপালস সাউন্ড) ও দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ শব্দের (৭৫ থেকে ৮৫ ডেসিবল) মধ্যে থাকলে মানুষ শ্রবণক্ষমতা হারাতে পারে। কারণ, এতে কানের কোষ (সেল) মারা যায়। কানের কোষ মারা গেলে তা মনোযোগের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এই কোষ নতুন করে আর তৈরি হয় না।

পরিবেশ অধিদফতরের ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্পের’ আওতায় প্রচারণায় বলা হয়েছে- শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস ও স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়। উচ্চ রক্তচাপ ও ফুসফুসজনিত জটিলতা, ক্ষুধামন্দা ও মানসিক চাপ, হৃদরোগ ও মস্তিষ্ক বিকৃতি, অনিদ্রা ও স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়।

অধ্যাপক ডা. মোস্তফা মাহফুজুল আনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতাল এবং আমার চেম্বারে গত পাঁচ বছরে শ্রবণজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এখন প্রতিদিন যত রোগী দেখি তার ৪৫ শতাংশই শ্রবণশক্তি হ্রাসজনিত সমস্যার। আর এর সবগুলোই শব্দদূষণের কারণে। শব্দের প্রভাব নানা কারণে হতে পারে। কেউ কানের কাছে জোরে চিৎকার দিলে, বাঁশি বাজালে কিংবা কানে হেডফোন লাগিয়ে দীর্ঘসময় গান শুনলে হতে পারে।’

‘তবে আমরা গত পাঁচবছরে যেসব রোগী পাচ্ছি তার অধিকাংশই রাস্তায় গাড়ির আওয়াজের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের সমস্যায় ভুগছেন। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে- হাইড্রোলিক হর্নটা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। এটা করতে পারলে শব্দদূষণের পরিমাণ অনেক কমে যাবে’— বলেন ডা. মোস্তফ মাহফুজুল আনোয়ার।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) তারেক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাইড্রোলিক হর্ন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরিসহ পণ্যবাহী বড় বড় গাড়িগুলো। কিছু বাসও ব্যবহার করে। অল্পসংখ্যক মোটরসাইকেলও আমরা পাই। আমরা নিয়মিত যানবাহনকে জরিমানা করি। কিন্তু হাজার হাজার গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার হয়। সেগুলো জরিমানা করে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সবচেয়ে সুবিধা হয়, যদি হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ করা হতো।’

সাহিকের চিকিৎসক সুমন তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক সময় আমরা শ্রবণজনিত সমস্যার যেসব রোগী পেতাম সেগুলোর অধিকাংশই ট্রেন কিংবা জাহাজের ইঞ্জিনরুমে কাজ করতেন। ট্রেনের হুইসেল, ইঞ্জিনের শব্দে কানে প্রভাব পড়ে। এখন যানবাহনের শব্দে কানে প্রভাব পড়েছে, এমন রোগীও আসছে। তবে এর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যন আমাদের কাছে নেই।’

‘রোগীদেরও অবহেলা থাকে। শ্রবণজনিত সমস্যা যখন প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে, তখন সাধারণত রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসেন না। একেবারে ফাইনাল স্টেইজে গেলে তখনই ডাক্তারের চেম্বারে আসেন। তখন রোগীর নিশ্চিত হিস্ট্রি না পেলে বলা যায় না যে, তিনি কীভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে শুধু চট্টগ্রাম শহর নয়, ঢাকাসহ দেশের অনেক বড় বড় শহরেও তো শব্দদূষণ হচ্ছে বলে আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি। এটা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কারণ শিশুদের ওপর এটা মারাত্মক প্রভাব ফেলে’— বলেন সুমন তালুকদার।

শব্দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুসারে, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, মিশ্র ও নীরব এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে আছে- প্রথমবার অনধিক এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড। পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।

তবে অভিযোগ আছে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে আইন ও বিধি আছে, তা নিয়ে দু’য়েক বছর পরপর শুধু প্রচারণা চলে। কিন্তু কয়েকদিন পর সব ঝিমিয়ে পড়ে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম গবেষণাগার কার্যালয়ের পরিচালক ইশরাত রেজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘শব্দদূষণ বাড়ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দূষণ কমে আসত। এরপর নির্মাণ কাজ চলছে বিভিন্ন এলাকায় সেটার প্রভাব আছে। আমরা শব্দদূষণ বন্ধে নিয়মিত প্রচারণা চালাই। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও পরিচালনা করি। আমরা সম্প্রতি যে প্রকল্প নিয়েছি, সেখানে পরিবহন শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করেছি। আমাদের মনে হচ্ছে, একটা ইতিবাচক ফল আসবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

উচ্চশব্দ কেড়ে নিচ্ছে শ্রবণশক্তি শব্দদূষণে নাকাল চট্টগ্রামবাসী


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ই-ক্যাবে প্রশাসক নিয়োগ
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:১৪

সম্পর্কিত খবর