বিচারক সংকটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, কার্যক্রম বন্ধ
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:০৮
ঢাকা: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ গত দেড় বছর ধরে ধীর গতিতে চললেও বিচারক সংকটে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম এখন বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা মহামারির কারণে গত দেড় বছর ট্রাইব্যুনালের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ কখনও ঝিমিয়ে চলছে, আবার কখনও পুরোপুরি বন্ধ থেকেছে। এই সময়ে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেননি কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, করোনাকালীন সীমাবদ্ধতা ও লোকবল সংকটের কারণে তারা কাজ করতে পারেনি। এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। আর আইনমন্ত্রী বলছেন, শিগগিরই বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের গতি ফিরিয়ে আনা হবে।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ধীর গতিতে চলাকালেই গত বছরের ২৯ নভেম্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান। গুরুতর অসুস্থ হয়ে গত ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) জেয়াদ আল মালুম। আর গত ২৪ আগস্ট মারা যান ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেলের অন্যতম সদস্য বিচারপতি মো. আমির হোসেন।
প্রসিকিউটররা জানান, ট্রাইব্যুনালের গুরুত্বপূর্ণ পদের এই তিনজনের মৃত্যু বিচার প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ প্রসিকিউটরদের অনেকেই বয়স ও অসুস্থতায় ন্যুব্জ। তারা নিয়মিত ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজে অংশ নিতে পারছে না। আর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তার ৩০টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ১০ জন। মূলত এসব কারণে ধীর গতিতে চলতে থাকা ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ বর্তমানে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতির মৃত্যুজনিত কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। তবে মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে অন্যান্য সব কার্যক্রম চলছে। করোনা মহামারির কারণে কিছুটা হয়তো ব্যাঘাত ঘটেছে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করছি। আশা করছি, অল্প সময়ের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হবে।’
এ বিষয়ে প্রসঙ্গে আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে ট্রাইব্যুনালসহ উচ্চ আদালতে বিচার কাজের গতি কমে এসেছে। দ্রুত বিচারক ও জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এ সংকট থেকে কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন। আর এজন্য যোগ্য ও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে ২০১০ সালের মার্চে যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ১১ বছরে বেশ কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ও দণ্ড কার্যকর করেছে ট্রাইব্যুনাল। বিচারকার্য পরিচালনায় গতি আনতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তবে বিচারের মাধ্যমে শীর্ষ ছয় যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের পর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টম্বর দুটি ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে একটি করা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দীর্ঘ ১৪ মাস পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের ৪২তম রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনালের ৪২ রায়ে ১২৪ জন আসামির মধ্যে ৬৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় ১২ জন আসামির মৃত্যু হয়েছে। আর খালাস পেয়েছেন মাত্র একজন আসামি। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩০টির বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি মামলা রয়েছে যুক্তিতর্কের পর্যায়ে, ১৮টি মামলা সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে এবং বাকি মামলাগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৩ হাজার ৮৩৯ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৭৭৮টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে জমা হয়েছে। অথচ প্রায় এক যুগে মাত্র ৭৮টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। যার ভিত্তিতে ৪২ মামলার রায় এসেছে। আর করোনাকালের গত দেড় বছরে রায় এসেছে মাত্র একটি।
এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ থেকে শুরু তদন্ত কাজ দ্রুত সম্পন্নের দাবি জানিয়ে আসছি। একইসঙ্গে আপিল বিভাগে পেন্ডিং থাকা মামলাগুলোও দ্রুত নিস্পত্তির দাবি জানিয়ে আসলেও সরকার আমাদের দাবির প্রতি কেউ কোনো কর্ণপাত করছে না। এ জন্য আমরা হতাশ।’
তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের পর থেকে ট্রাইব্যুনালের গতি কমে আসতে আসতে এখন বিচারকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালে খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। শহিদ পরিবারের লোকজন বিচার না দেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে। আবার অনেক অপরাধী শাস্তি না পেয়ে মারা যাচ্ছে। এটা হতে পারে না।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা মনে করি শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম একটা বড় অর্জন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ৭১’র মানবতাবিরোধীদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু বিচারের বর্তমান অবস্থাতে আমরা হতাশ এবং অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। আমরা চাই অল্প সময়ের মধ্যে জনবল ও বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে চলমান মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হোক। কারণ বিচারকে বিলম্বিত করলে সেটি অর্থহীন হয়ে পড়ে।’
বিচারক সংকট এবং ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিচারক নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিচারকাজ গতিশীল করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শিগগিরই বিচারক দেওয়া হবে। আশা করছি, খুব শিগগিরই রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নিয়োগ দেবেন।’
সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম