ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি ৬৭% বাড়লেও গণপরিবহন বেড়েছে ২%
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:২৭
ঢাকা: বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন গণপরিবহনে বাসকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছে, সেখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ঘটছে উল্টো ঘটনা। ঢাকার রাস্তায় দিনকে দিন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়ছে না গণপরিবহনের সংখ্যা। এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির মধ্যে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার যথাক্রমে ৪৯ ও ১৮ শতাংশ বাড়লেও গণপরিবহন বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ।
এদিকে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংকুচিত হচ্ছে চলাচলের পথও। যে কারণে বাড়ছে যানজট, নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলের উপযোগী না থাকাই এর অন্যতম কারণ। তারা রাস্তাঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি গণপরিবহনে সংস্কার আনার পরামর্শ দিয়েছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন রেলকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা বাড়ানোর দিকে।
ঢাকার গণপরিবহন পরিস্থিতি
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) তথ্যানুযায়ী, ২৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকা শহরে বর্তমানে খাতা-কলমে বাস রুটের সংখ্যা ২৯১টি। এই সংখ্যক রুটে আড়াই হাজার কোম্পানির ৩০ হাজার গাড়ি চলাচল করে। জানা গেছে, এসব রুটের মধ্যে কিছু বর্তমানে অকার্যকর। আবার অনেক জায়গায় রুট থাকলেও নামমাত্র বাস চলাচল করে। আবার এমন অনেক রুট আছে সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বাসের সংখ্যা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে ঢাকার রাস্তায় তিন হাজার ৬৪৩টি বাস-মিনিবাস নামানো হলেও ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নামানো হয় ২ হাজার ১০৭টি। আর চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত হয়েছে ২২০টি বাস-মিনিবাস। এর মধ্যে ৯৭টিই ঢাকাতে। তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে ঢাকা শহরে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭টি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখেরও বেশি।
সুত্র মতে, ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি আট লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৫টি, যা মোট গাড়ির ৪৯ শতাংশ। প্রাইভেটকার নিবন্ধিত হয়েছে তিন লাখ ৮ হাজার ৮৬০টি, যা মোট গাড়ির ১৮ শতাংশ। আর বাসের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৯৭৮টি, যা মোট গাড়ির ২ শতাংশ।
এই চিত্রই বলে দিচ্ছে, রাজধানীর সড়কে অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় গণপরিবহন তেমন বাড়ছে না। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দিনকে দিন যানজট তীব্র হচ্ছে। কয়েকটি সংস্থার তথ্য মতে, এই দীর্ঘ যানজটে গড়ে দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর বছরে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ হাজার কোটি টাকা।
বাস মালিকরা যা বলছেন
বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে দীর্ঘদিন ধরে রুট পারমিট স্থগিত থাকাকে দায়ী করেছেন ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীতে রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। ব্যবসায়ীরা নতুন বাস নামিয়ে যাবে কোথায়? এর মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আরোপিত বিধিনিষেধের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ঢাকায় রুট পারমিট স্থগিত রাখা হয়েছে। তা কবে তুলে নেওয়া হবে, কিংবা আদৌ চালু হবে কি না তা জানা নেই। সরকার যদি নতুন করে রুট পারমিট না দেয়, তাহলে পুরানো রুটেই ভাঙাচোরা গাড়ি বাদ দিয়ে নতুন গাড়ি নামানো হবে।’
নগর পরিকল্পনাবিদদের বক্তব্য
বাসের সংখ্যা ও সেবার মান কমে যাওয়ার পেছনে পরিকল্পনা ও উপযুক্ত নীতিমালার অভাবকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নগর পরিকল্পনাবিদ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার সড়ককে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে, পরিবহন খাতকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। রাজধানীর উন্নয়নে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি পরিবহন খাত নিয়ে প্রণয়ন করা আছে আরএসটিপি। এই দু’টির সমন্বয় ঘটিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আসবে। মানুষ গণপরিবহনের প্রতি নির্ভরশীল হবে।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে যতগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই ছোট ছোট গাড়ি ব্যবহারে মানুষ যেন উৎসাহিত হয় সে ধরনের প্রকল্প; যেমন- ফ্লাইওভার, রাস্তা চওড়া করা— এমন কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু গণপরিবহন সম্পর্কিত কৌশলগত পরিকল্পনাপত্রে বলা ছিল, ধাপে ধাপে বিশৃঙ্খল গণপরিবহনকে রুট নির্ধাণের মাধ্যমে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা হবে এবং ফুটপাথকে পথচারী বান্ধব করা। বাসগুলো কোম্পানি বেইজড পরিচালনা করা হবে। তার কোনোটিই এখনও কার্যকর হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বিশৃঙ্খলভাবে সেবা দিতে গিয়ে বাসগুলোর সেবার মান কমে যাচ্ছে। ফলে যাদের বাসে যাতায়াত করার কথা, তাদের কেউ প্রাইভেটকার কিনে ফেলছেন, কেউ কিনছেন মোটরসাইকেল, আবার কেউ অন্য উপায় খুঁজছেন। ছোট ছোট গাড়ি বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো, গণপরিবহন মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। সেবার মান যাচ্ছেতাই।’
বর্তমান গণপরিবহনে অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এসটিপিতে ছোটখাটো খরচবিহীন কাজগুলো করেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। কিন্তু আমরা যদি রাস্তার ক্যাপাসিটি বাড়াতে পারতাম তাহলে বলার ছিল, পরের ধাপে গিয়ে এই সাধারণ বাসে হবে না। কারণ তার যে ক্যাপাসিটি তা লোকাল ক্যাপাসিটির মতো। একে যদি একটু উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন করে কম বাসে বেশি যাত্রীকে সেবা দিতে হয় তাহলে দ্রুত গতি করতে হবে। দ্রুত গতি করার জন্য তাকে রাস্তার সর্বোৎকৃষ্ট অংশটুকু ব্যবহার করতে হবে। কেউ সেখানে ঢুকতে পারবে না। সবাই তখন অন্য রুটে যানজটে থাকবে। অন্যদিকে বাসগুলো যখন রেলের মতো দ্রুত চলে যাবে, নির্ভরযোগ্য যখন হবে, তখন যাত্রীরা নিজের গাড়ি ছেড়ে বাসে চলাচল করবে। এ বাস সাধারণ বাস নয়। এটাকে অবশ্যই মানসম্মত হতে হবে। বড় দরজা থাকবে, নিম্নগামী ডেক থাকবে, পাটাতন দিয়ে মানুষ সহজে যাতে উঠতে পারে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশের পুরো জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বসবাস ঢাকা ও এর আশে পাশে। প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু থাকার পাশাপাশি তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা রাজধানী ঢাকামুখী হওয়ায় মানুষের মূল স্রোত এখানেই। মানুষের চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে রাজধানীতে চলাচলের জন্য নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের মধ্যে পড়ে না।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, রাজধানীর সড়কে সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলাচল করতে পারে। অথচ এখন ঢাকায় নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৭ লাখের বেশি। যে কারণে রাজধানীর যানবাহনের জট কমার বদলে বাড়ছেই। জানা যায়, যানজট নিরসনে গত ১০ প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঢাকার রাস্তায় ঢেলেছে সরকার। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বরং ১০ বছর আগের চেয়ে গাড়ির গতি কমে ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। সেইসঙ্গে গাড়ির কারণে বেড়েছে পরিবেশ বিপর্যয়।
পরিবেশবাদীদের বক্তব্য
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজধানীতে ছোট গাড়ি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং গণপরিবহনের অভাব। রাজধানী ঢাকাতে যেসব গণপবিহন চলাচল করে তাতে ভদ্রভাবে চলাচলের উপায় নেই। যে কারণে মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী যাতায়াতের ব্যবস্থা করে নিচ্ছে। ফলে গাড়ির ধোঁয়া পরিবেশকে ভীষণভাব দূষিত করছে। যানজট বাড়ছে, আর মানুষের আয়ু কমছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির জন্য বার বার সুপারিশ করেছি। গণপরিবহনে শৃঙ্খলার পাশাপাশি এটি যদি মানসম্মত করা যায় এবং উন্নত দেশের মতো রেলকে যদি রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত করা যায় তাহলে এই সমস্যা থাকবে না।’
রাজধানীর যানজট কমানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকাকে নিয়ে প্রণয়ন করা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা- আরএসটিপিতে (২০১৫-২০৩৫)। সেখানে বলা আছে, পথচারীদের চলাচলে অগ্রাধিকার, সাইকেলে চলাচলের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করার কথা। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়েছেন আরএসটিপি বাস্তবায়নের।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘ঢাকা একটি মেগা সিটি। পরিবহনের সর্বোৎকৃষ্ট আধুনিক বিনিয়োগ করতে হবে গণপরিহনে। সেই ধারণা থেকেই কিন্তু মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা আসে। এখন ফুটপাথকে চলাচলের উপযোগী করা, বাস রুট দ্রুত ফ্রাঞ্চাইজ করা, একটি কোম্পানির বাস চলবে এবং সাইকেল চালানোর জন্য অবকাঠামোর উন্নয়ন যানজট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার চাইলেই তা পারে। সেটা রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক উপায়ে হোক- এই সক্ষমতা তাদের রয়েছে।’
চলমান উদ্যোগ
ঢাকার যানজট নিরসনে বাস রুট রেশনালাইজেশনের পাশাপাশি কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা পদ্ধতি প্রবর্তনে ২০১৮ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের নেওয়া তখনকার পদক্ষেপ বিবেচনায় নিয়ে একটি কমিটি করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০ সদস্যদের ওই কমিটি দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সমীক্ষা শেষে একটি প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে ঢাকার ২৯১ রুটের পরিবর্তে ৪২টি রুটে ২২ কোম্পানির গণপরিবহন ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া নগরীতে চলাচলরত আড়াই হাজার কোম্পানির প্রায় ৩০ হাজার পরিবহনের পরিবর্তে ৯ হাজার ২৭টি গণপরিবহন পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দীন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদিও গণপরিবহন ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সওজের নয়, কিন্তু ২০ বছর আগে রাজধানী ঢাকার যে পরিস্থিতি ছিল তা এখন নেই। এখন ঢাকায় রাস্তায় গাড়ি বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু মান বাড়েনি ন্যূনতম। রাস্তায় যেসব বাস এখন চলাচল করে তাতে সবধরনের যাত্রীর পক্ষে চলাচল করা সম্ভব না।’
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমাতে হলে বাসকে সকলের চলাচলের উপযোগী করতে হবে। এ নিয়ে ঢাকা পরিবহন কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) কাজ করছে। অচিরেই হয়তো এর ইতিবাচক একটা পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব।’
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম