লাইসেন্স ছাড়াই ৩ বছরে ধামাকা হাতিয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা!
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:২৩
ঢাকা: তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো প্রকার অনুমোদন ও লাইসেন্স ছাড়াই দেশে ব্যবসা করে আসছে ধামাকা শপিং ডটকম। লাইসেন্স না থাকায় কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এতদিন ব্যবসা করেছে ধামাকা। আর এর মাঝেই হাতিয়ে নিয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা।
বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। এর আগে বুধবার ভোরের দিকে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে র্যাব-২ ধামাকার সিওও সিরাজুল ইসলাম রানা, ইমতিয়াজ হাসান সবুজ ও ইব্রাহিম স্বপনকে গ্রেফতার করে।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কারসাজির মাধ্যমে লাখ লাখ গ্রাহককে পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করার বিষয়টি সম্প্রতি দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।’
তিনি বলেন, ‘যাত্রা শুরুর পর ২০১৮ সালে ধামাকা ডিজিটাল ২০২০ থেকে ধামাকা শপিং ডটকম নামে কার্যক্রম শুরু করে। এই তিন বছর তারা ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে। ওই অ্যাকাউন্টে এ পর্যন্ত ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হলেও সেখানে বর্তমানে লাখ খানেক টাকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সেলার বকেয়া রয়েছে প্রায় ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি টাকা। এছাড়া গ্রাহকদের বকেয়া ১৫০ কোটি টাকা ও গ্রাহকদের রিফান্ড চেক বকেয়া আছে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা।’
আল মঈন বলেন, ‘বিভিন্ন লোভনীয় গগনচুম্বী অফারের মাধ্যমে প্রলুব্ধ করে সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সংস্থা ই-কমার্সের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কাঠামো নিয়ে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ই-কমার্সের আড়ালে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন আলোচনায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি উঠে এলে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়ের করেন।’
গত ২৩ সেপ্টেম্বর টঙ্গী পশ্চিম থানায় এক ভুক্তভোগী প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ‘ধামাকা শপিং ডট কম’র চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিওওসহ ১১জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-১৩। এছাড়া আরও বেশকিছু ভুক্তভোগীর অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন সময়ে অপমান হেনস্থা ও ভয়ভীতির স্বীকার হয়েছেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এরই ধারাবাহিকতায় আজ প্রতিষ্ঠানটির ওই তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয় ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। সিরাজুল ইসলাম রানা ধামাকা শপিং ডটকম’র সিওও। ইমতিয়াজ হাসান সবুজ মোবাইল ফ্যাশন ও লাইফ স্টাইল’র ক্যাটাগরি হেড এবং ক্যাটাগরি হেড (ইলেক্ট্রনিক্স) হিসেবে ইব্রাহীম স্বপন নিযুক্ত রয়েছেন।’
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান জানান, ধামাকা শপিং ডটকমের কোনো প্রকার অনুমোদন ও লাইসেন্স নেই। এমনকি ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টও নেই। আর গ্রেফতারকৃতরা ২০২০ থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটি নেতিবাচক এগ্রেসিভ স্ট্র্যাটিজি নিয়ে মাঠে নামে।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানিয়েছে, আর্থিক সংকটের কারণে গত কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং ডিপো ভাড়া বকেয়া রয়েছে। পাশাপাশি চলতি বছরের জুন থেকে কর্মচারীদের বেতন বকেয়া রয়েছে। চলতি বছরের গত এপ্রিল থেকে ধামাকা শপিং ডটকম অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার কারণে জুলাই হতে সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ধামাকা শপিং ডটকম’র ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘মহাখালীতে তাদের প্রধান কার্যালয় এবং তেজগাঁও বটতলা মোড়ে একটি ডেলিভারি হাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০০টি ব্যবসায়িক চেইন রয়েছে। তার মধ্যে নামি-দামি প্রতিষ্ঠানের নামও উঠে এসেছে।’
ধামাকা শপিং ডটকম ছাড়াও তাদের আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন: ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রোট্রেড ফুড এবং বেভারেজ লিমিটেড এবং মাইক্রোট্রেড আইসিক্স লিমিটেড ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। এছাড়া হোল্ড মানি প্রসেস প্ল্যান অর্থ্যাৎ গ্রাহক ও সরবরাহকারীর টাকা আটকিয়ে রেখে অর্থ সরিয়ে ফেলাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর নানাবিধ অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করা হতো। যাতে দ্রুততম সময়ে ক্রেতা বৃদ্ধি পায়।
ধামাকা শপিং ডটকম’র গ্রাহক সংখ্যা তিন লাখের উপরে। মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, মোটরবাইক, গৃহস্থলীপণ্য ও ফার্নিচারসহ বিভিন্ন অফারে বিক্রি করা হতো। প্রতিষ্ঠানটি লোভনীয় অফারগুলো হলো- সিগনেচার কার্ড ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, ধামাকা নাইটে ৫০শতাংশ পর্যন্ত, রেগুলারে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ছাড়। সিগনেচার কার্ড অফারটি গত মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়। মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য সরবরাহ করে অর্থ সরিয়ে গ্রাহকদের চেক দেওয়া হয়। তার পর ধীরে ধীরে সব অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ধামাকা শপিং ডট কম ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে মূলত তারা ইনভেনটরি জিরো মডেল এবং হোল্ড মানি প্রসেস প্লান ফলো করত।
এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, ‘শুধু ধামাকা নয় এরকম আরও যারা লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছে, তাদের ব্যাপারেও খোঁজ-খবর নেওয়া হবে। যদি কারও বিরুদ্ধে এরকম প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম