জোট ভাঙনে চিন্তিত নয় বিএনপি, ভাবনায় যুগপৎ আন্দোলন
১ অক্টোবর ২০২১ ২৩:১৫
ঢাকা: ২০ দলীয় জোট থেকে একেক করে শরিক দলগুলো চলে গেলেও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় জোটের প্রধান দল বিএনপি। তাদের ভাবনায় এখন যুগপৎ আন্দোলন। রাজনৈতিক জোট গঠনের চেয়ে যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে দলটি।
জোটের পুরোনো শরিক খেলাফত মজলিসের জোট ছাড়ার ঘোষণার পর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানা গেছে।
শুক্রবার (১ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন প্রবীণ রাজনীতিক খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহম্মদ ইসহাক। জোট ছাড়ার কারণ হিসেবে জোটের নিষ্ক্রিয়তা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে ২০ দলীয় জোটকে ‘অকার্যকর’ করার বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি। একই অভিযোগ তুলে গত ১৪ জুলাই বিএনপি জোট ছাড়ে আরেক পুরোনো শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম।
দলীয় সূত্রমতে, একের পর এক পুরোনো শরিকরা ২০ দলীয় জোট ছেড়ে চলে গেলেও বিষয়টিকে ‘বড় ঘটনা’ হিসেবে দেখছে না বিএনপি। যে লক্ষ্য নিয়ে ‘খর্ব শক্তি’র এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠন করা হয়েছিল, সে লক্ষ্য পৌঁছানোর পথ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড চাপে ২০ দলীয় জোটের ধর্মভিত্তিক প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলাম একেবারেই নিষ্ক্রিয়, জোটের দ্বিতীয় শক্তিশালী দল ইসলামী ঐক্যজোট ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জোট ছেড়ে চলে গেছে, তৃতীয় শক্তিশাল দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও আড়াই মাস আগে ঘোষণা দিয়ে বিএনপি জোট থেকে বিদায় নিয়েছে।
আরও পড়ুন- ‘অকার্যকর’ জোট ছাড়ল খেলাফত মজলিস
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন এক পরিস্থিতিতে বিএনপি জোটের অপেক্ষাকৃত ‘দুর্বল’ ও ‘খর্ব শক্তি’র দল খেলাফত মজলিসের সরে যাওয়া বিএনপিকে খুব বেশি ভাবাচ্ছে না। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, প্রায় ২ বছর ধরে জোটে নিষ্ক্রিয় খেলাফত মজলিস জোট ছেড়ে চলে যাওয়ায় জোট এবং বিএনপির রাজনীতির ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমনিতেই ২০ দলীয় জোট দীর্ঘ দিন ধরে নিষ্ক্রিয়। সেই জোট থেকে কোনো শরিক দল যদি চলে যায়, তাতে জোট ও বিএনপির রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের যাত্রা
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৯৯৯ সালে জামায়াতে ইসলামী, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ইসলামী ঐক্য জোটকে সঙ্গে নিয়ে চার দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে বিএনপি। কিছু দিন পরই হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জোট থেকে বের হয়ে যান। কিন্তু নিজের সমর্থকদের নিয়ে জোটে থেকে যান জাপার মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু। সেই সময় জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে ছিল— বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও ইসলামী ঐক্যজোট।
এর পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল পুরোনো শরিকদের সঙ্গে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। সেই সময় এই জোটের শরিক দল ছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, আন্দালিভ রহমান পার্থ’র নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট, কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদ নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, প্রয়াত শফিউল আলম প্রধান নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, শয়াখ আব্দুল মমিনের নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, প্রয়াত এইচ এম কামরুজ্জামান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), প্রয়াত শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), ইসলামিক পার্টি, প্রয়াত শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী, জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল), পিপলস লীগ ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও কমরেড সাঈদ আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের একটি অংশ বিএনপি জোটে যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।
জোটের ভাঙন
শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর। ওই বছর জুনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় প্রয়াত শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী, আগস্টে বেরিয়ে যায় প্রয়াত শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি জোট ছেড়ে দেয় প্রয়াত আব্দুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট। দুই বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে বিএনপি জোট ছেড়ে দেয় জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির একাংশ।
এরপর ২০১৯ সালের ৬ মে বিএনপি জোট ত্যাগ করে আন্দালিভ রহমান পার্থ’র নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। আর গত আড়াই মাসের ব্যবধানে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস।
তবে ভাঙেনের পর জোটের সংখ্যাতাত্ত্বিক নাম ঠিক রাখতে বারবার জোড়াতালির আশ্রয় নিয়েছে বিএনপি। ন্যাপ ভাসানী চলে যাওয়ার পর কল্যাণ পার্টির গাইবান্ধা জেলা শাখার তৎকালীন সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামকে দিয়ে বিকল্প ন্যাপ ভাসানী, এনপিপি যাওয়ার পর ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে দিয়ে বিকল্প এনপিপি, ইসলামী ঐক্যজোট যাওয়ার পর অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিবকে দিয়ে বিকল্প ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ন্যাপ চলে যাওয়ার পর দলটির ঢাকা মহানগর নেতা শাওন সাদেকীকে দিয়ে বিকল্প বাংলাদেশ ন্যাপ, এনডিপি চলে যাওয়ার পর দলটির বহিষ্কৃত নেতা কারী আবু তাহেরকে দিয়ে বিকল্প এনডিপি গঠন করে বিএনপি। এভাবে ২০ দলীয় জোট ‘ভগ্নাংশ’ জোটে পরিণত হয়। সে কারণেই নাম সর্বস্ব দল ও সংগঠন নির্ভর জোটের ভাঙন নিয়ে এই মুহূর্তে বিএনপির তেমন কোনো ভাবনা নেই।
এ প্রসঙ্গে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন যুগপৎ আন্দোলনের কথা ভাবছি। যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর