ঢাকা ঘুমালেও পঙ্গু হাসপাতালে জাগে রাত
৩ অক্টোবর ২০২১ ২৩:১৭
ঢাকা: শনিবার (২ অক্টোবর) দিবাগত রাত ২টা বেজে ১৭ মিনিট। নিস্তব্ধ শহরে তখন সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের পঙ্গু হাসপাতালে তখনও চলছে ছোটাছুটি। কেউ আসছেন স্বজনদের নিয়ে, কেউবা বন্ধুকে নিয়ে; আবার কেউ আসছেন দুর্ঘটনার শিকার অপরিচিত কাউকে নিয়ে। আর তাদের সেবা দিতে ব্যস্ত একদল চিকিৎসাকর্মী। সীমিত জনবলে কার্যত অসম্ভবকে সম্ভব করতে কাজ করে যাচ্ছেন ওয়ার্ড বয়রাও। এক্স-রে মেশিন নিয়ে ব্যস্ত টেকনোলজিস্টও রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যস্ততার শেষ নেই অস্ত্রোপচার কক্ষেও। একের পর এক আসা রোগীদের কারও হাত, আবার কারও পা দুর্ঘটনায় ক্ষত; কেউ আবার ভেতরের যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন। শুধু রাজধানী থেকেই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা আসছেন চিকিৎসাসেবা নিতে। যে রোগীদের ৮০ শতাংশ মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এসেছেন চিকিৎসা নিতে।
রাত ২টা ৪০ মিনিট। জরুরি বিভাগের বেডে শুয়ে আছেন মুরশেদুল নামে ২০ বছর বয়সী এক তরুণ। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। মোটর ইঞ্জিনের রিকশা চালানোর সময় দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। দ্রুততার সঙ্গে চালাতে গিয়ে গতি হারিয়ে রিকশা উল্টে মুরশেদুলের পা আটকে যায়। আর তাতেই বাম পায়ে আঘাত পান তিনি। সঙ্গে থাকা তার বাবা জানান, বাম পা অবশ হয়ে আছে। সেটি নাড়াতেও পারছেন না, ওঠাতেও পারছেন না। তাই নিয়ে আসা হয়েছে পঙ্গু হাসপাতালে।
পাশের বেডেই বসে আছেন মুজাহিদ ইসলাম নামে ৩৬ বছর বয়সী এক যুবক। তার ডান হাতে ঝুলছে প্লাস্টার। পেশায় রাজমিস্ত্রি মুজাহিদ বিল্ডিংয়ের কাজ করার সময় আঘাত পান বিকেলের দিকে। ওই সময় খুব একটা ব্যাথা না থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়ে যায়। আর তাই সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে গাবতলী থেকে এসেছে পঙ্গু হাসপাতালে।
ঠিক তার একটু সামনেই বেডে বসে আছেন সোনিয়া নামে এক তরুণী। মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। আর তাতেই বিপত্তি। মোটরসাইকেল তার সঙ্গে থাকা ভাইসহ দুর্ঘটনায় পড়েন। পরে একজন বন্ধুকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে এসেছেন। চিকিৎসক জানিয়েছেন এক্স-রে করাতে হবে।
সুমন চৌধুরী নামে আরেকজন শুয়েছিলেন তার বাম দিকে। কলার বোনের মাঝখানটা ভেঙেছে মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে। চিকিৎসক তাকে ২১ দিনের বিশ্রামের পরামর্শ দিলেও সেটি কমানোর অনুরোধ করছিলেন তিনি। কারণ দুই সপ্তাহ পরেই তার এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান আছে। কিন্তু চিকিৎসক জানালেন, এক্ষেত্রে কিছুই করার নেই।
অবশ্য কিছুটা ভিন্ন চিত্রও আছে। রাহাত চৌধুরী নামে ৪১ বছর বয়সী এক বাবা তার সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে এসেছেন কোলে করে। পঙ্গু হাসপাতালের গেইটে গাড়ি থেকে নেমে জরুরি বিভাগে যাচ্ছিলেন। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে জানান, একমাত্র সন্তান আফনান রাতে খেলতে গিয়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে যায়। এতে হাতে আঘাত পেয়ে ব্যথায় কান্না করছিল। তাই তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই রাতে পঙ্গু হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও ভরসা করা যায় না। যত ভিড়ই থাকুক না কেন এখানকার জরুরি বিভাগে অন্তত চিকিৎসাটা পাওয়া যায়।’
একদিকে যখন নানারকম দুর্ঘটনার শিকার রোগীদের ভিড়, তখন ঠিক তার পাশেই দায়িত্বরত চিকিৎসকের ব্যস্ততা। জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে রিপোর্ট দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। প্রতিবেদক কথা বলতে চাইলে ডা. মেহেদি জানান, রোগীদের সেবা দিতে হবে আগে। তাই একটু সময় লাগবে কথা বলতে।
পঙ্গু হাসপাতালের এক্স-রে রুমের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধুমাত্র রাত ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত প্রায় ৬০ জনের এক্সরে করানো হয়েছে। প্রতিদিনই এমন হয়ে থাকে। যার অধিকাংশই বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার। জরুরি বিভাগের সামনেই টিকেট কাউন্টারে দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানালেন, শুধুমাত্র ১ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে ২ অক্টোবর রাত ১২টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ২২৬ জন। ২ অক্টোর রাত ১২টার পরে দুইটা পর্যন্ত ২৬ জন জরুরি বিভাগে টিকিট কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের ৮০ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। জরুরি বিভাগ থেকে বের হয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে যাওয়ার পরে দেখা যায়, সেখানে লম্বা লাইন। কথা বলে জানা যায়, লাইনের সবাই অপেক্ষায় আছেন ভেতরে যাওয়ার জন্য।
রাত ৩টা। জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে ব্যস্ত ডা. মেহেদি জানালেন, কথা বলার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া যাবে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগে প্রতি রাতেই এরকম কমন চিত্র থাকে। তবে কতজন আসেন সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অফিসিয়ালি জানাবেন। এখানে যারা আসেন তাদের অধিকাংশই দুর্ঘটনার শিকার। বিশেষ করে ৮০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। অনেক রোগী আসেন রেফার্ড হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। এছাড়াও বিভিন্ন পারিবারিক ও এলাকাভিত্তিক কলহের জেরে মারামারি করে ভাঙা হাত-পা নিয়ে গুরুত্বর অবস্থায় আসেন অনেকে।’
তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র জরুরি বিভাগেই নয়, আপনি অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে যান; সেখানেও এই মুহূর্তে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী পাবেন। একেকজনের একেক ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন। আর সেসব কিছু ম্যানেজ করেই আমাদের এখানে চিকিৎসা দিয়ে যেতে হয়। এখানে এসে চিকিৎসা না পেয়ে ফেরত গেছেন, এমনটা কেউ বলতে পারবেন না। হ্যাঁ কিছুটা সময় নিলেও গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা চিকিৎসা দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা যে শুধু আজকেই বিষয়টা এমনটা নয়। অনেক সময় দেখা যায়, একসঙ্গে অনেক রোগী হাসপাতালে চলে এসেছেন। তখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে গুরুতর রোগীদের আগে প্রায়োরিটি দেওয়া হয়।’
পরে কথা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘২৪ ঘণ্টাই এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রোগী আসেন। সেইসব রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। ঈদের ছুটি বলেন বা সরকারি ছুটি— সবসময়েই এখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়ে থাকে। সব সময় রোগীদের চাপ থাকে- এটা স্বাভাবিক। কারণ, মানুষ একটা ভরসা নিয়ে আসে এখানে। আর তাই এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী সবাই চেষ্টা করেন সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করতে।’
এদিকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গণি মোল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সবার মাঝে ভয় কাজ করছিল তখনও পঙ্গু হাসপাতাল নিরবচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে গেছে। কারণ, দুর্ঘটনার শিকার সকলের আস্থার জায়গা হলো হাসপাতাল। আর আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সেবা দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। আমাদের অপারেশন থিয়েটার কখনও বন্ধ থাকে নি এই দেড়/দুই বছরে।’
তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ কিছুটা সীমাবদ্ধতার কথা অস্বীকার করি না, যেগুলো আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে, যখন কেউ কেউ বলে থাকেন, হাসপাতালে চিকিৎসক নেই। এত বড় একটি হাসপাতালে চিকিৎসক থাকবে না- এমনটা কি হতে পারে? আমাদের দেশের পরিস্থিতিতো আর এমন না যে, প্রত্যেক রোগীর সেবা দেওয়ার জন্য একজন করে চিকিৎসক রেখে দিতে পারব। এরপরও সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টাই আমরা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগীদের হাসপাতালের বাইরে থেকে কেউ কেউ বলে, হাসপাতালে চিকিৎসক নেই। তাই বাইরের কোথাও যেন রোগী ভর্তি করা হয়। রীতিমতো গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে অনেকে। সেই কথাগুলো অনেকে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়। এমন উসকানি যারা দেয় তাদের পরিচয় আশা করি আর নতুনভাবে দিতে হবে না। আমরা তাদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে রাখতে পেরেছি এখন পর্যন্ত। কিন্তু রাস্তায় গিয়ে তো আর চেক দেওয়া সম্ভব না। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, পঙ্গু হাসপাতালে এলে চিকিৎসা সেবা পাওয়া ছাড়া কেউ ফেরত যাবে না।’
রাত ৩টা ২০ মিনিট। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে বের হওয়ার সময় দেখা যায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুই তরুণ ও এক বৃদ্ধকে। রাজধানীর আদাবরে বাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার দুর্ঘটনায় তিনজনই আহত হয়েছেন।
হাসপাতালের মূল গেইটের বাইরেই দেখা যায় অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে। কথা বলে জানা যায়, ভেতরে রোগীদের কেউ যদি ভর্তি না হয় তবে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। হাসপাতালের ভেতরে যাওয়া মানা। তাই বাইরেই দাঁড়িয়ে তাদের অপেক্ষা।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম