‘বিলাসিতায় নজর, গবেষণায় সময় দেয় না— সমস্যা এটাই’
৪ অক্টোবর ২০২১ ২১:২৪
ঢাকা: যেকোনো খাতেই এগিয়ে যেতে হলে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মানুষ এখন বিলাসিতার কারণে গবেষণায় সময় ব্যয় করতে চায় না বলেও আক্ষেপ করেছেন তিনি। এটিকেই এই সময়ের অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবেও মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমি তো একজন রাজনীতিবিদ। আমি তো আর মডেল না যে আমাকে মডেলের মতো সবসময় সেজেগুজে থাকতে হবে। কিন্তু এখন সবাই মডেল হতে চায়। বিলাসী হতে চায়। গবেষণা করতে চায় না। আমাদের দেশে এটাই সমস্যা— বিলাসিতার দিকে নজরটা এত বেশি যে গবেষণার কাজে কেউ সময় দিতে পারছে না।
সোমবার (৪ অক্টোবর) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনে যোগদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফেরার পর ওই সফর নিয়ে মতবিনিময় করতেই এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণায় সরকারের গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিভিন্ন খাতে গবেষণার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে আসছে। তবে অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার পর আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নেন। এর জন্য তারা টাকা পান। কিন্তু ওই সময়টাকে তারা গবেষণার কাজে নিয়োজিত করেন না। আবার যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন না, তারাও গবেষণায় খুব একটা মনোযোগ দেন না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকদের গবেষণার বড় ধরনের সুযোগ তৈরি করা হলেও অধিকাংশই চিকিৎসকই গবেষণার বদলে প্রাইভেট ক্লিনিক বা চেম্বারে রোগী দেখতে বেশি আগ্রহী বলে আক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রী। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য এই মেডিকেলটি করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের গবেষণাই হয় না বলতে গেলে। খুব কম, হাতেগোনা কয়েকজন গবেষণা করেন। আমি ঠিক বুঝি না, এখানে এই অনীহাটা কেন? আমি সত্যি কথা বলিছ— এটাই বাস্তবতা।
আরও পড়ুন-
- ‘রিফিউজি থাকলে বোধহয় কারও কারও লাভই হয়’
- ‘মানুষ কেন বিএনপিকে ভোট দেবে— এই প্রশ্ন করুন’
- ‘বাংলাদেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদন হবে, আমরা ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছি’
- বাংলাদেশের ডিজিটাল সিস্টেম আমেরিকার চেয়েও ভালো: প্রধানমন্ত্রী
গবেষণা খাতে ঠিক একই বাস্তবতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গবেষণায় বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছি। আরও যা যা প্রয়োজন, আমি সব দিয়েছি। এখন তারা কেন গবেষণা করে না, সেই জবাব তো আমি দিতে পারব না। গবেষণা নিয়ে সবারই কেন যেন এক ধরনের অনীহা! অথচ গবেষণায় টাকার অভাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আলাদা তহবিল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট তহবিল থেকে গবেষণা, উচ্চ শিক্ষা, পিএইচডি পর্যায়ের জন্য বরাদ্দের ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েরও বরাদ্দ আছে। সবই আছে, কেবল গবেষণাটাই নেই!
বিলাসবহুল জীবনযাপনের দিকে মানুষের ঝোঁককেই এর অন্যতম কারণ মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ওই যে বড়লোক হব, টাকা বানাব, ভালো থাকব, এই করব, ওই করব— ওইসব বিলাসিতার দিকেই নজরটা সবার। সামরিক শাসকরা যখনই কোনো দেশের ক্ষমতায় আসে, তখন বিলাসের দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। আমাদের এই দেশে কিন্তু এই চিন্তা ছিল না। মানুষ একটা আদর্শ নিয়ে চলত। কিন্তু এখন দৃষ্টিটা চলে গেছে বিলাসের দিকে। টাকার প্রতি লোভ আর মায়া একটু বেশি হয়ে গেলে সমস্যাটা দেখা দেয়।
তবে এই পরিস্থিতিও সবসময় থাকবে না, পরিস্থিতির বদল আসবে— এ বিষয়েও আশাবাদী শেখ হাসিনা। প্রত্যয় নিয়ে তিনি বলেন, পরিবর্তন (চেঞ্জ) হবে। আমি বললাম, পরিবর্তন আসবে। আমি তো লেগে আছি সবসময়। আর এই গবেষণা হচ্ছে বলেই তো আজ দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আজ লাউ, শিম, গাজর, টমেটো— সবই তো ১২ মাসই পাওয়া যাচ্ছে। দেশি জাতের বিলুপ্তপ্রায় মাছ গবেষণার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত নিয়ে, হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। একেবারেই যে গবেষণা হচ্ছে না, তাও না। হচ্ছে, আরও হবে। তবে কৃষির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য— এই দুই খাতে আরও বেশি বেশি গবেষণা করতে তাগিদ দেন তিনি।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর এই প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সে কারণেই একটু বেশি সময়ও তিনি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, করোনার সময় আজ বসলাম। আমার মনে হয় এতদিন বসতে না পারাটা আজকে উসুল হয়ে গেছে। যত সময় চেয়েছেন, আমি তত সময় দিয়েছি। যত প্রশ্ন করেছেন, সব উত্তর দিয়েছি। করোনার এই দেড়-দুই বছর যে বসতে পারিনি, সেটার অভাব কিন্তু উসুল হয়ে গেছে।
পরে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী প্রায় ২ ঘণ্টা ১৮ মিনিটি এই সংবাদ সম্মেলনে সময় দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শুরুতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। গণভবনে প্রান্তে সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। সেখানে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও তেজগাঁও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রান্তেও উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। দুই স্থানে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছ থেকেই প্রশ্ন নিয়ে উত্তর দেন সরকারপ্রধান।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর
জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন