Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রইল বাকি জামায়াত

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ অক্টোবর ২০২১ ১৭:৫০

ঢাকা: ১৯৯৯ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) এবং দেশের শীর্ষ উলামাদের সম্মিলিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইসলামী ঐক্যজোটকে (ধর্মভিত্তিক পাঁচটি রাজনৈতিক দলের মোর্চা) নিয়ে চার দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। সময়ের ব্যবধানে এদের প্রায় সবাই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ছেড়ে গেছে। অবশিষ্ট রয়েছে কেবল জামায়াত।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষকদের মতে, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া এবং রাজপথে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে মোকাবিলার জন্য দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘বিরোধী জোট’ গঠনে উদ্যোগী হয় বিএনপি। সাংগঠনিক শক্তি এবং জনভিত্তির পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট ও সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় পার্টি (জাপা) এবং জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কাছে টানেন খালেদা জিয়া।

বিজ্ঞাপন

বিএনপি নেত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রয়াত শায়খুল হাদিস আজিজুল হক ও আব্দুর রব ইউসুফী নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, প্রয়াত মুহিউদ্দীন খান ও মুফতি ফজলুল হক আমিনী নেতৃত্বাধী ইসলামী মোর্চা, প্রয়াত মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলামী পার্টি, প্রয়াত মাওলানা শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী ও মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং মছলেহউদ্দীন আহমেদ আবু বকর মিয়া নেতৃত্বাধীন ফরায়েজি আন্দোলন চার দলীয় জোটে যোগ দেয়।

কিন্তু ভিত মজবুত হওয়ার আগেই চার দলীয় জোটে ভাঙন শুরু হয়। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জোট থেকে বেরিয়ে যান। তবে তার দলের মহাসচিব প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জু এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) গঠন করে চার দলীয় জোটে থেকে যান। পরবর্তী সময় বিজেপির নেতৃত্বে আসেন নাজিউর রহমান মঞ্জুর বড় ছেলে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে ভোলা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। টানা পাঁচ বছর সংসদ এবং সংসদের বাইরে বিএনপির পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। অতঃপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের ৬ মে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ছেড়ে দেন আন্দালিব রহমান পার্থ।

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে শায়খুল হাদিস আজিজুল হক ও আব্দুর রব ইউসুফী নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিসের মুফতি শহীদুল ইসলাম নড়াইল-২ আসন থেকে, মুহিউদ্দীন খানের নেতৃত্বাধীন ইসলামী মোর্চার মুফতি ফজলুল হক আমিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ থেকে, প্রয়াত মাওলানা শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথীর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস যশোর-৫ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু জামায়াতের দুইজনকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলেও ইসলামী ঐক্যজোট থেকে নির্বাচিত কাউকে মন্ত্রিত্ব দেয়নি বিএনপি। ফলে ভেতরে ভেতরে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। অতঃপর এক/এগারোর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কিছু দিন আগে শায়খুল হাদিস আজিজুল হক বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ছেড়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেন।

এর আগে, খেলাফত মজলিস ভেঙে দুই অংশে ভাগ হয়। একাংশ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ও শিবিরের সাবেক সভাপতি আহমেদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে বিএনপি জোটে থেকে যায়। গত শুক্রবার (১ অক্টোবর) এই খেলাফত মজলিসই বিএনপি জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রয়াত আশরাফ আলী বিশ্বনাথী ও মুফতি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বাধীন থাকা অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে তেমন কোনো ঝামেলা হয়নি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে দলটি খুব দাপটের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু আশরাফ আলী বিশ্বনাথীর মৃত্যুর পর শায়খ আব্দুল মুমিন ও নূর হোসাইন কাসেমীর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে অন্তর্কোন্দল দেখা দেয়।

শায়খ আব্দুল মুমিনের মৃত্যুর পর ভেঙ্গে দুই ভাগ হয়ে যায় জমিয়ত। একাংশের নেতৃত্ব দেন নূর হুসাইন কাসেমী, অন্য অংশের নেতৃত্ব দেন মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। এ দুই অংশ নিয়েই অস্বস্তিতে ছিল বিএনপি। কারণ, হেফাজতের শীর্ষ নেতা হিসেবে বেশ কয়েকবার গণভবনে যেতে হয়েছিল নূর হুসাইন কাসেমীকে। অন্যদিকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস।

অতঃপর গত বছর ১৩ ডিসেম্বর মারা যান নূর হুসাইন কাসেমী এবং এ বছর ৩১ মার্চ মারা যান মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। মাত্র সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে দলের দুই অংশের দুই প্রধান নেতার মৃত্যুতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। এর পর ১৪ জুলাই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বেরিয়ে যায় ২২ বছরের পুরোনো মিত্র জমিয়ত।

বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনের সময় প্রয়াত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন দলটির নাম ইসলামী মোর্চা থাকলেও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের সময় ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ নামে নিবন্ধন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান মুফতি ফজলুল হক আমিনী। পরবর্তী সময়ে এই ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ নামেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন আমিনী। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর তার মৃত্যুর পর দলটির চেয়ারম্যান হন আব্দুল লতিফ নেজামী। ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি এই ইসলামী ঐক্যজোটও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বেরিয়ে যায়।

চার দলীয় জোটের অন্য দুই পুরোনো শরিক ফরায়েজি আন্দোলন এবং নেজামী ইসলাম পার্টি জোটে কখনই সক্রিয় ছিল না। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামী নেজামে ইসলাম পার্টিরও আমির ছিলেন। আর ফরায়েজি আন্দোলনের সভাপতি মছলেহউদ্দীন আহমেদ আবু বকর মিয়া আমৃত্যু ক্ষমতাসীন দলগুলোর আশপাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। ফলে চার দলীয় জোট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপির সঙ্গে তার সম্পর্কও শিথিল হয়ে যায়।

২২ বছর আগে বিএনপি’র নেতৃত্বে জামায়াত, জাতীয়পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট (চারটি দল) নিয়ে চার দলীয় জোট গঠিত হয়। মূলত জোটের সাতটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে পাঁচটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক এখনও অটুট রয়েছে। ২০১১ সালের পর চরম দুঃসময় বিশেষ করে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রচণ্ড চাপ আসলেও জামায়াতকে ছাড়েনি বিএনপি। বরং জামায়াতের পক্ষ নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাদের এক হাত নেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২৩টি আসন জামায়াতের জন্য ছেড়ে দেয় বিএনপি। ওই আসনগুলোতে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে ইসিতে নিবন্ধন হারানো জামায়াত।

দলীয় সূত্র মতে, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কিছুটা খারাপ হলেও ‘সঙ্গীহারা’ বিএনপি এই মুহূর্তে জামায়াতের সঙ্গে ‘প্রকাশ্য’ দ্বন্দ্বে জড়াবে না। ভরসা রাখবে পুরোনো মিত্র জামায়াতের ওপরই। আবার জামায়াতও স্বেচ্ছায় বিএনপি নেত্বাধীন জোট ছাড়বে না। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় বিএনপির সঙ্গেই থেকে যাবে তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি ভরসা রাখে জনগণের ওপর, বিশেষ কোনো দলের ওপর না। তবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা বিএনপির অন্যতম নীতি এবং কৌশল।’

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

জামাায়াত বিএনপি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর