Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিসিএস পরীক্ষার ২১ বছর পরে নিয়োগ, বাবাকে উৎসর্গ করলেন ডা. সুমনা

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৭ অক্টোবর ২০২১ ২৩:৫৯

বিসিএস দেওয়ার ২১ বছর পর নিয়োগ পাচ্ছেন ডা. সুমনা সরকার

ঢাকা: ডা. সুমনা সরকার। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বসেছিলেন ২৩তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষায়। সেটি ২০০০ সালের কথা। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর লিখিত পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন তিনি। তবে বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে জটিলতার কারণে তার মৌখিক পরীক্ষা আর নেয়নি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।

এরপর আদালতের দ্বারস্থ হন ডা. সুমনা। দীর্ঘ ১৮ বছরের আইনি লড়াই শেষে অবশেষে জয় পেয়েছেন তিনি। তার মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছে পিএসসি। এরপর তাকে ২৩তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হিসেবে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ ২৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বসার প্রায় ২১ বছর পর স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন ডা. সুমনা সরকার।

বিজ্ঞাপন

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা ডা. সুমনার বাবা অধ্যাপক ডা. অমল কৃষ্ণ সরকারও ছিলেন একজন চিকিৎসক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আবদুল আহাদের সই করা সনদ, ২০০৩ সালের ২১ জুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদপত্র, মুক্তি বার্তার নম্বর— সবই ছিল ডা. অমল কৃষ্ণ সরকারের। কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েই জটিলতার অভিযোগে ডা. সুমনার মৌখিক পরীক্ষা নেয় নি পিএসসি।

তাতে হাল ছাড়েননি ডা. অমল কৃষ্ণ সরকার ও ডা. সুমনা সরকারসহ পরিবারের সদস্যরা। প্রতিকার চেয়ে ডা. সুমনা সরকার হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলার রায় হয়। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করে পিএসসি। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ। ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি হলে পিএসসিকে ডা. সুমনা সরকারের অসমাপ্ত মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।

বিজ্ঞাপন

ডা. সুমনাকে সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসির বিজ্ঞপ্তি

আদালতের এই রায়ের পর চলতি বছরের ১ জুন পিএসসির চেয়ারম্যান বরাবর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আবেদন করেন ডা. সুমনা সরকার। ৩০ জুন পিএসসি’র যুগ্ম সচিব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) নুর আহমদের সই করা চিঠিতে সুমনাকে জানানো হয়, রায় বাস্তবায়নে সুমনার মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরে সেই মৌখিক পরীক্ষা নিলে তাতে উত্তীর্ণ হন সুমনা।

সবশেষ আজ বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) পিএসসি’র যুগ্ম সচিব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) নুর আহমদের সই করা আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে ২৩তম বিশেষ বিসিএসে (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের জন্য সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে ডা. সুমনা সরকারকে।

২০০৩ সালে পিএসসি মৌখিক পরীক্ষা না নিলে আদালতে যেমন আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন ডা. সুমনা, তেমনি পেশাজীবনেও বসে ছিলেন না। চট্টগ্রামের লায়ন্স দাতব্য চক্ষু হাসপাতালে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে আসছিলেন তিনি।

প্রায় দেড় যুগ পর সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া ডা. সুমনা সরকার সারাবাংলাকে বলেন, দীর্ঘ একটি সময় আমার জীবন থেকে চলে গেছে। বর্তমান যা হয়েছে, তা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা ছাড়া কোনো কিছু বলার নেই। তবে আমার বাবার জন্য খারাপ লাগছে। তিনি আজ বেঁচে নেই। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে তিনি ২০১৮ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমিও লড়ে গেছি পরিস্থিতির সঙ্গে।

তিনি বলেন, যখন বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেই তখন বাবা আমাকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য হলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আইনি লড়াইয়ের শুরু থেকেই তিনি সঙ্গে ছিলেন। গত বছর যখন আদালতের রায় পাই, তখন আমার বাবা আর সঙ্গে নেই আমাদের। তিনি এই রায় দেখে যেতে পারেননি। আজ যে ফলাফল পেয়েছি, সেটি আমার বাবাকে উৎসর্গ করছি।

২০০০ সালে যখন বিসিএস পরীক্ষার অংশ নেন, তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন ডা. সুমনা সরকার। তার সেই সন্তান এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। ডা. সুমনা বলেন, জীবন থেকে বড় একটি সময় চলে গেল— এটাই দুঃখ। ওই সময়ে নিয়োগ পেলে দেশের মানুষের জন্য আরও অনেক কিছু হয়তো করতে পারতাম। কিন্তু সেই সুযোগটিই পেলাম না। চাইলেও আর সেই সময় ফিরে পাব না— এটিই বাস্তবতা। এখন যখন নিয়োগ পেয়েছি, তখন বেশিদিন হয়তো দেশের জন্য কাজ করার সৌভাগ্য আর পাব না। কারণ আমার তো বয়স হয়েছে। ২০ থেকে ২১টি বছর পার হয়ে গেছে প্রায়।

এই নিয়োগে ডা. সুমনার পরিবারের সবাইও স্বাভাবিকভাবেই খুশি। সুমনা বলেন, আমার পরিবারের সবাই খুশি। আমার একজন সন্তান এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ে। তবে আমার এই দীর্ঘ লড়াইয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন আমার স্বামী প্রবীর কুমার দাশ। তিনিও একজন চিকিৎসক। তিনি চেয়েছেন যেন এর প্রতিকার হয়। তার সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল বলেই আমরা এই সংগ্রাম করতে পেরেছি। একইসঙ্গে আমার যারা আইনজীবী ছিলেন, তারাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। তাদের সহযোগিতা ছাড়া হয়তো আজকের এই দিনটি আসত না।

এতদিন পর নিয়োগ পাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা বিষয়ক জটিলতাও চলে আসছে সামনে। ডা. সুমনা বলেন, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। এখন আমাকে সেই পদেই নিয়োগ দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। কিন্তু আসলে এতটা দীর্ঘ সময় পরে যখন কাজ শুরু করব, তখন দেখা যাবে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে বয়সের পার্থক্যটা হবে অনেক বেশি। আমার জন্য এবং আমার সঙ্গে যারা নতুন কর্মস্থলে কাজ করবেন, তাদের সবার জন্যই বিষয়টি কিছুটা বিব্রতকর হবে। তাই আশা করব, আমাকে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার সময় যেন জ্যেষ্ঠতার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

ডা. সুমনার পরিবারটিকে চিকিৎসক পরিবারই বলা যায়। তার ছোট সন্তানটি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। তাকেও চিকিৎসক হিসেবেই গড়ে তুলতে চান তিনি। ডা. সুমনা বলেন, আমাদের পরিবারে চিকিৎসক পেশাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। আমার দাদু পাকিস্তান আমলে চিকিৎসক ছিলেন। আমার বাবাও একজন চিকিৎসক ছিলেন। তারা মানুষকে সেবা দেওয়াটাকেই ধর্ম মনে করতেন। আমরাও সেভাবেই বড় হয়েছি। আমার ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, ছোট বোন, বড় বোনের এক মেয়েসহ পরিবারের অনেকেই চিকিৎসাসেবায় যুক্ত। আমার ছোট ছেলেটিও আশা করছি বড় হয়ে পরিবারের ধারাবাহিকতাতেই একজন চিকিৎসক হিসেবে দেশ ও দশের সেবা করবে।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

২১ বছর পর নিয়োগ ২৩তম বিসিএস টপ নিউজ ডা. সুমনা সরকার পিএসসি সরকারি কর্ম কমিশন স্বাস্থ্য ক্যাডার

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর