Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১০ম শ্রেণি পাস কাদের জনপ্রশাসনের ‘অতিরিক্ত সচিব’!

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৯ অক্টোবর ২০২১ ১৯:৫৮

গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার ভুয়া অতিরিক্ত সচিব কাদের ও তার সহযোগীরা

ঢাকা: দেড় কোটি টাকা দামের প্রাডো গাড়িতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে অহরহ প্রবেশ করতেন সচিবালয়ে। সঙ্গে রাখতেন প্রটোকল অফিসার। তার ছিল অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তাও। অথচ সে এসএসসির গণ্ডিও পেরোয়নি। লেখাপড়া করেছে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপরও সে নাকি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। পাশাপাশি মুসা বিন শমসেরের নিয়োগপ্রাপ্ত একজন উপদেষ্টাও সে। বনানীতে তার রয়েছে ছয় হাজার বর্গফুটের একটি অফিস, যার ভাড়া ছয় লাখ টাকা। এসব পরিচয় আর বনানীর অফিস দেখিয়ে ব্যাংকের মোটা অঙ্কের লোন পাস ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে শত শত মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আর এসব অভিযোগে প্রতারক আব্দুল কাদেরকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৯ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘প্রতারক কাদের নিজেই অস্ত্র ও ওয়াকিটকি নিয়ে চলাফেরা করতো। ঘনিষ্ঠতা ছিল সমালোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমের সঙ্গেও। সচিবালয়ে যখন তখন প্রাডো গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়তো। এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভুয়া স্টিকার ও ফ্লাগস্ট্যান্ড ব্যবহার করতো সে। নিজেকে পরিচয় দিত একজন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। শুধু তাই নয়, প্রতারক আব্দুল কাদের নিজেকে ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের নিয়োগকৃত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে পরিচয় দিতো।’

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, মুসা বিন শমসেরের নগদ অর্থ ও বিভিন্ন স্থাপনার কাস্টোডিয়ান হিসেবে টাকা-পয়সা কোনো ব্যাপার না জাহির করে চাকরিপ্রার্থী, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের প্রতারিত করতো কাদের। গত ১৪ বছর ধরে দেশের শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি ও খামার তৈরি করার নামে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। আর এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আব্দুল কাদেরসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার চার জন হলো- ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের, আব্দুল কাদেরের সততা প্রপার্টিজের চেয়ারপারসন ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া, অফিস ম্যানেজার শহিদুল আলম ও অফিস সহায়ক আনিসুর রহমান।

গত ৭ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে রাত একটা পর্যন্ত ডিবির সাইবার ক্রাইম বিভাগের টিম রাজধানীর কাওরান বাজার, মিরপুর ও গুলশানে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। মিরপুর ৬ নম্বরের বাসা থেকে বাইরে যাওয়ার সময় নিজের প্রাডো গাড়িতে গ্রেফতার হয় আব্দুল কাদের। এসময় তার পকেটে পাওয়া যায় অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড ও কোমরে পাওয়া যায় একটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন ও এক রাউন্ড গুলি। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে ওয়াকিটকি, ওয়ার্ক অর্ডারের কাগজপত্র, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার ও লোন দেওয়ার বিভিন্ন কাগজপত্র জব্দ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদেরের আদি বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচর। সে ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সন্তান। তার বাবা জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমায় সন্দ্বীপে। জীবিকা উপার্জন করতে থাকে মাঝিগিরি ও মাছ ধরে। এমন ভূমিহীন ভাসমান আব্দুল কাদের এখন অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের চৌধুরী হিসেবে নিজের পরিচয় দেয়। সে চড়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা দামের গাড়িতে। বনানীর পাশাপাশি তার অফিস আছে কারওয়ান বাজারেও। মিরপুর ৬ নম্বরে বসবাস করলেও একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে গুলশান ও মিরপুরে।’

তিনি জানান, এছাড়াও কাদের নয়তলা বাড়ি কিনেছেন গাজীপুরের বোর্ডবাজারে, ৮ বিঘার বাগানবাড়ি রয়েছে গাজীপুরের পুবাইলে। ডাচ বাংলা ব্যাংক, মার্কেনটাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে তার একাধিক অ্যাকাউন্ট। যেখানে রয়েছে লাখ লাখ টাকা। অঢেল সম্পদের মালিক এই ভুঁইফোড় আব্দুল কাদেরের নেই কোনো বৈধ উপার্জন। প্রতারণা, চাপাবাজি ও মিথ্যাই তার একমাত্র পুঁজি।

ডিবি প্রধান বলেন, ‘ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রতারক আব্দুল কাদের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতো। কিন্তু বর্তমানে গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করা অসুবিধাজনক। সেজন্য সে নিজেই অস্ত্র ও ওয়াকিটকি নিয়ে চলে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে।’

নাম সর্বস্ব একাধিক কোম্পানির মাধ্যমে প্রতারণা

প্রতারক আব্দুল কাদেরের নাম সর্বস্ব কয়েকটি কোম্পানির নাম হলো- ঢাকা ট্রেড করপোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রোপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস, ডানা মটর্স ইত্যাদি। প্রতারক আব্দুল কাদের বড় রকমের প্রতারণা করেন হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশনের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ মাধ্যমে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালে দেশের শত, শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি ও খামার তৈরি করার নামে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।

২০ কোটি টাকার বেশি লোন পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি টাকার উপরে লোন পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা করতো প্রতারক আব্দুল কাদের। লোন পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রতারক অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদেরের ইন্টারভিউ ও কনসালটেন্সির জন্য নেওয়া হতো ৫০ হাজার টাকা। তারপর লোনের জন্য প্রোফাইল বানিয়ে দেয়ার কথা বলে নেওয়া হতো ২ থেকে ১০ লাখ টাকা। এছাড়া ২০ কোটি বা তদূর্ধ্ব অংকের লোন পাইয়ে দিতে ডাউনপেমেন্ট হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হিসেবে নেওয়া হতো লোন প্রার্থীদের কাছ থেকে। পরবর্তী সময়ে কাউকে লোন করিয়ে দিতে না পারলেও হাতিয়ে নেওয়া টাকার অংশ ঋণ হিসেবে দিতো এই প্রতারক।

ঠিকাদারির নামে প্রতারণা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি করেছেন বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতো প্রতারক কাদের। এবং সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার বিক্রি করতো। তাছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা জামানত রেখে দিতো, যেগুলো দিয়ে আবার সে প্রতারণা করতো। এমনকি বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়ার নামেও বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে সে।

মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায়

সততা প্রপার্টিজের নামে আব্দুল কাদের জমি ও স্থাপনা কেনার জন্য নামেমাত্র কিছু টাকা বায়না দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করে। যেগুলো দিয়ে পরবর্তী সময়ে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায় করতো। এই কাজগুলো করার জন্য আব্দুল কাদের নিজেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি বলতেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে জনপ্রশাসনে এসেছেন তিনি। এমনকি গর্ব করে বলতেন, সেনাবাহিনী, পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্নস্তরে তার সহকর্মী বন্ধু ও অনুজরা কর্মরত থাকায় কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। প্রতারক আব্দুল কাদের নিজেকে ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের নিয়োগকৃত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে পরিচয় দিতো। প্রিন্স মুসার সঙ্গে একাধিক ছবি তুলে চাকরি প্রার্থী ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করতো সে।

ডিবি জানিয়েছে, ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের, তার স্ত্রী ও সহকর্মীদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা এবং তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা রয়েছে। এর আগে, তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণা, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে ছয়টি মামলা রয়েছে।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভুয়া অতিরিক্ত সচিব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর