শিশুর কান্নায় যেখানে জেগে থাকে রাত
১১ অক্টোবর ২০২১ ১৩:২৬
ঢাকা: ২ অক্টোবর (শনিবার) দিবাগত রাত ৩টা বেজে ২৭ মিনিট। রাজধানীসহ দেশের সব প্রান্তের শিশুরা হৈ চৈ’র মধ্য দিয়ে দিন পার করে ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কেউ বাবা-মার বুকে নিশ্চিন্তে, কেউ আবার প্রিয় মানুষের কাছে লেপ্টে আছে। তাদের স্বপ্নে ধরা পড়ছে খেলার মাঠ, ক্লান্ত বিকেল, ফড়িং দিন। কিন্তু সেই রাতেই উল্টো চিত্র রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের শিশু হাসপাতালে। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে তখন শিশুদের নিয়ে ছোটাছুটিতে ব্যস্ত অভিভাবকরা। এদের অনেকেই এসেছেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে, আবার কেউ কেউ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। শিশুকে কোলে নিয়ে অপেক্ষায় মা-বাবা। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে তাদের অপেক্ষা যেন শেষ হতে চায় না। ব্যস্ত চিকিৎসকরা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি অভিভাবকদের কাউন্সেলিংয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
রাত ৩টা ৪০ মিনিট। সাড়ে নয় মাস বয়সী সাজ্জাদকে নিয়ে তার মা-বাবা এসেছেন লক্ষ্মীপুর থেকে। কথা শুরু করতেই জানা গেল, জন্মের পর থেকেই বাচ্চার হৃদরোগের সমস্যা। এখন তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। তাই লক্ষ্মীপুর থেকে রাতেই রওনা দিয়ে ঢাকায় এসেছেন। কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া এখন আর শ্বাস নিতে পারছে না সাজ্জাদ।
আগে কেন শিশু হাসপাতালে আসা হয়নি?— জানতে চাইলে সাজ্জাদের বাবা আরিফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিল। তাই ঢাকায় আনা হয়নি। তবে গত দু’দিন ধরে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় সেখানে আর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আর তাই ঢাকায় নিয়ে আসা।’
রাত ৩টা ৫০ মিনিট। ৭ মাস বয়সী তানহাকে কোলে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য টিকিট কাটছিলেন তার বাবা রবিউল ইসলাম। কথা বলে জানা গেল, রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে তারা এসেছেন। সকাল থেকে তানহার প্রায় ৩০ বার পাতলা পায়খানা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি। কিন্তু রাত বাড়তেই দুর্বল হতে থাকে তানহা। তাই তাকে হাসপাতালে আসা হয়েছে।
ঠিক তার পাশেই চার মাস বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আরেক মা। পাশেই থাকা শিশুটির বাবা নওশাদ ইসলাম সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সকাল থেকে জ্বর জ্বর ভাব ছিল বাচ্চার। কিন্তু রাতে হঠাৎ জ্বর বেড়ে যায়। একইসঙ্গে তার শ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছিল। তাই মধ্য রাতেই বাচ্চাকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে আসতে হয়েছে।’
টিকিট কাউন্টারে কথা বলে জানা যায়, শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ থেকে ১৮০ শিশুকে নিয়ে আসেন তাদের অভিভাবকরা। এদের বেশির ভাগই আসেন রাজধানীর বাইরে থেকে। জ্বর, সর্দি, ডেঙ্গুসহ নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদেরও নিয়ে আসা হয় এখানে। তবে বেশির ভাগ বাচ্চার বয়সই দেখা যায় ২৮ দিনের কম।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখা যায় চিকিৎসা দিতে গিয়ে ব্যস্ত তিনি। তিনি কিছু সময় অপেক্ষা করতে বললেন। রোগী দেখার ফাঁকে এক সময় কথা বললেন দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. শিবলি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক মা-বাবা সন্তানকে নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তারা এমন সময়ে এসেছেন যখন বাচ্চাকে ভর্তি করা প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত বেড না থাকায় অনেককেই ভর্তি করতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘এখানে যে শিশুরা আসছে তাদের অধিকাংশই দেখা যায় নিউমোনিয়া, ঠান্ডা-কাঁশি ও ডেঙ্গুসহ নানা রোগে আক্রান্ত। ডেঙ্গুর পাশাপাশি ঠান্ডা-কাশি আক্রান্ত শিশুদের নিয়েও আসছেন অভিভাবকরা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, শিশুদের নিয়ে আসা হচ্ছে দেরিতে। এটা কিন্তু অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে অভিভাবক বাচ্চাকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করাচ্ছেন। কিন্তু সেটা আসলে কার্যকর হচ্ছে না। দেখা গেছে, একটি বাচ্চার সারাদিনে ৩০ বার টয়লেট করেছে। কিন্তু তাকে নিয়ে আসা হয়েছে রাত দুইটার দিকে। এক্ষেত্রে আসলে তিন থেকে চার বার টয়লেটের পরেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই তো এতবার টয়লেট হলে দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা। এক্ষেত্রে যখন ৩০ বার টয়লেট শেষে ছোট্ট শিশুকে নিয়ে আসা হয় তখন আর কিছু বলার থাকে না।’
ডা. শিবলি বলেন, ‘বর্তমানে অনেক শিশুরই কিন্তু জন্মগতভাবে হৃদরোগের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের আগে থেকেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। একটু আগে একজন রোগী এসেছে। তাকে ভর্তি করানো প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের এখানে বেড খালি নেই। যদি বিকেল তিনটার দিকে আসতো তখন হয়তো আমরা একটা চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু এখন তার অবস্থা এমন যে, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার আওতায় আনতেই হবে। কারণ শিশুটির চিকিৎসা করাতে কার্ডিয়াক ইউনিটের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমাদের অন্য সরকারি হাসপাতালে রেফার্ড করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘অভিভাবকরা সচেতন হলে অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। সেক্ষেত্রে শিশুরা দ্রুত সুস্থও হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায়, অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে নিজেরাই ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে বাচ্চাকে খাওয়ায়। কেউ আবার অবৈজ্ঞানিকভাবেও চিকিৎসা দিয়ে থাকে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এতে করে শিশুদের ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়।’ যখনই শিশুর মাঝে কোনো উপসর্গ দেখা দেবে তখনই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বানও জানান এই চিকিৎসক।
রাজধানীর শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিজওয়ানুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু হাসপাতালে সব সময়ই চিকিৎসা সেবাটা দেওয়া হয়ে থাকে। দেখা যায়, জরুরি বিভাগে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, অভিভাবকরা শিশুদের দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। এটি আসলে সবার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুটা দেরিতে হলেও তাদের মাঝে একধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম হয়। শিশুর মাঝে সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাই শিশুদের শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগ নির্ণয়টা জরুরি। বিন্দুমাত্র খামখেয়ালি বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।’ তাই শিশুর মাঝে কোনো উপসর্গ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান এই চিকিৎসকেরও।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম