প্রবাসে পাসপোর্ট উইংয়ের নিয়োগে উপেক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
১৩ অক্টোবর ২০২১ ২১:২১
ঢাকা: বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত সেবায় ধীরগতিসহ প্রবাসীদের নানা ধরনের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবল না থাকার কারণে অনেক দূতাবাস প্রবাসীদের প্রয়োজনীয় সেবা দিতে না পারার কথাও স্বীকার করেছে বিভিন্ন সময়। দীর্ঘ দিনের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে ৯ বছর আগেই বিদেশি মিশনগুলোতে পাসপোর্ট ও ভিসা উইং চালুর প্রস্তাব এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দর্শনার্থী ও প্রবাসীদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত উন্নত সেবা নির্বিঘ্ন করতে এই উইং চালুর অনুমোদন দিয়েছিলেন। পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে উইংগুলো চালু হলেও কমেনি প্রবাসীদের পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত দুর্ভোগ। জানা গেছে, পাসপোর্ট অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োজিত করার কারণেই শেষ পর্যন্ত পাসপোর্ট ও ভিসা উইংগুলো প্রয়োজনীয় সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এখনো।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১২ সালে ১৯টি মিশনের জন্য সৃজন করা হয়েছিল ৭৩টি পদ। মিশনের গুরুত্ব অনুযায়ী প্রতিটি শাখায় রাখা হয়েছিল তিন থেকে পাঁচ জনকে। উইংপ্রধান হিসেবে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগের (ডিআইপি) কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পদেও পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল পদগুলো সৃজনের সময়। কিন্তু ২০১৫ সালে উইংগুলো চালু হওয়ার পর থেকে বিদেশি কোনো মিশনে এখন পর্যন্ত পাসপোর্ট অধিদফতরের একজন কর্মকর্তাকেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর বদলে পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সিনিয়র সহকারী সচিবদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাসপোর্ট-ভিসা প্রক্রিয়াকরণে পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রয়েছে বিশেষ দক্ষতা। বিশেষায়িত এই দক্ষতা অন্য কোনো বিভাগের সরকারি কর্মকর্তাদের নেই। সে কারণেই দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে প্রবাসে বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর বদলে সহকারী সচিবদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা কোনো কাজে আসেনি।
পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি মিশনগুলোর পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। উপেক্ষিত হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সবশেষ সুপারিশমালাও। আর পাসপোর্ট অধিদফতর যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে, সেই মন্ত্রণালয় থেকেই বিদেশি উইংয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপেক্ষা করা হয়েছে।
জানা যায়, সরকার প্রবাসীদের মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) দেওয়ার উদ্যোগ নেয় ২০১২ সালে। এ উদ্দেশ্যে মিশনগুলোতে পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ের পাশপাশি বিশেষ মেশিন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, অভিজ্ঞ জনবল না থাকলে মিশনগুলোতে এই সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। অভিবাসন ও পাসপোর্ট বিভাগের কর্মকর্তারা পাসপোর্ট ও ভিসা প্রক্রিয়াকরণে বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ। তাদের মিশনে নিযুক্ত করা গেলে পাসপোর্ট ও ভিসায় উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬৬টি মিশনের জন্য ৩৬৬টি পদ সৃজনের প্রস্তাব করেছিল। ২০১২ সালের ২ জুন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পাসপোর্ট ও ভিসা শাখার জন্য পদ তৈরি করার অনুরোধ জানায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১৯টি বাংলাদেশি মিশনের জন্য ৭৩টি পদ সৃজনের অনুমোদন দেয়। ওই সময় যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়— বিদেশি মিশনগুলোর পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ের প্রধান হবেন পাসপোর্ট অধিদফতরের উপপরিচালক মর্যাদার কর্মকর্তারা। তবে ২০১৫ সালের ১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা গেজেটে বলা হয়, প্রথম সচিব পদগুলো সিনিয়র সহকারী সচিবদের দ্বারা পূরণ করা হবে এবং পদগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
সংশ্লিষ্ট এই বিষয়ের সরকারি আদেশের কপি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের কপি সারাবাংলার হাতে রয়েছে।
পাসপোর্ট অধিদফতর ও বিদেশি মিশনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিনিয়র সহকারী সচিবদের নিযুক্ত করার পর মিশনে পাঠানোর আগে তাদের কয়েকদিনের জন্য প্রশিক্ষণ দেন পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কিন্তু স্বল্প সময়ের সেই প্রশিক্ষণ প্রবাসীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়— এটি প্রমাণিত বলেই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই প্রবাসীরা সঠিক সময়ে সঠিক সেবা পাচ্ছেন না। আর সেই সেবা পেতে তাদের দেশে এসে পাসপোর্ট অধিদফতরে (ডিআইপি) ভিড় করতে হচ্ছে।
অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, পাসপোর্ট বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন কাজ করে। অথচ বিদেশি মিশনের পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ে নিয়োগের সময় প্রস্তাবনা থেকে বিচ্যুত হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই সিনিয়র সহকারী সচিবদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাতে একদিকে উপেক্ষিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, অন্যদিকে পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তারা সেবা দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। প্রবাসীরাও পাসপোর্ট ও ভিসা বিষয়ক উন্নত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
হতাশ হয়ে ডিআইপির কয়েকজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, পাসপোর্ট তালিকাভুক্তি একটি প্রযুক্তিগত কাজ। মিশনগুলোতে এই কাজে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ দিলে তারা সেই সেবাটি যথার্থভাবে দিতে পারতেন। কিন্তু সেই পদগুলোতে যারা রয়েছেন, তাদের সেই প্রয়োজনীয় দক্ষতাটুকু নেই। তারপরও তারা ওই পদগুলো সুরক্ষিত রাখতে চায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিআইপির একজন কর্মকর্তা বলেন, এরকম একটি অদ্ভূত ব্যবস্থা বহাল থাকায় ডিআইপি কর্মীদের যাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা রয়েছে, তারা তাদের প্রাপ্য সুযোগ পাচ্ছেন না।
এদিকে, পাসপোর্ট অধিদফতরের প্রশাসন শাখা সূত্র জানাচ্ছে, সৃষ্ট পদগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাসপোর্ট অধিদফতরের। কিন্তু নিয়োগ পাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এতে একদিকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে সেবাগ্রহীতারা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একইসঙ্গে পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও অসন্তুষ্টি বাড়ছে। বিদেশে মিশনগুলোতে যাওয়ার জন্য যে ভালো কাজ করার প্রতিযোগিতা ছিল, সেটি ম্লান হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে অভিবাসন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, সঠিক ব্যক্তি সঠিক অবস্থান না পেলে সেবার মান সর্বোত্তম হবে না। যিনি পাসপোর্ট তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত নন, তিনি বায়োমেট্রিক্স ও ফটোগ্রাফের মতো প্রযুক্তিগত সমস্যা বুঝতে পারবেন না। যেমন— একটি পাসপোর্ট হয়তো কেবল যাচাইয়ের জন্য মুলতবি রয়েছে। যিনি বিষয়টি জানেন না, তিনি বুঝতেই পারবেন না যে এর অর্থ হলো সেটির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট প্রয়োজন।
পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের কেন উইংয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি— জানতে চাইলে ডিজি বলেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমি বলব, পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের সেসব পদের জন্য নির্বাচন করা হলে সেবার মান আরও উন্নত হতো।
নির্দেশনায় পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন সিনিয়র সহকারী সচিবদের নিয়োগ দিয়েছে— জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব (ইমিগ্রেশন -১, ২, নিরাপত্তা শাখা এবং অভিবাসন -১ বিভাগ) জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাসপোর্ট ও ভিসা শাখা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। বিদেশি উইংয়ে প্রথম সচিব পদগুলো অ্যাডমিন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের দিয়ে পূরণ করা হয়ে থাকে। তাদের এই পদে চার বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে মিশনে পাঠানো হয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে।’ এ সংক্রান্ত নথিপত্রের কথা উল্লেখ করলেও এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মিশনগুলোতে যখন কাউকে পাঠানো হয় তার আগে সারাদেশে অ্যাডমিন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হয়। সেসব আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশি মিশনে পাসপোর্ট ও ভিসা উইং কর্মকর্তা হিসেবে পাঠানো হয়। পাঠানোর আগে পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাদের ১৫ দিনের একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রশিক্ষণ কোনোভাবেই বিশেষায়িত একটি সেবার জন্য যথোপযুক্ত নয়।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর
পাসপোর্ট অধিদফতর পাসপোর্ট ও ভিসা উইং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বিদেশি মিশন