মোটরসাইকেলে আয়ের মুখ দেখছে চর হরিণাঘাটের তরুণরা
১৪ অক্টোবর ২০২১ ০৮:১৬
মানিকগঞ্জ: জেলার হরিরামপুর উপজেলায় পদ্মা নদীবেষ্টিত দুর্গম চর হরিণাঘাট। প্রমাণ আয়তনের এই চরে রয়েছে চার চারটি ইউনিয়ন। বসবাস লাখো মানুষের। এর চারদিকে পদ্মা নদীর অথৈ পানি। ফলে যোগাযোগব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। নদী পেরোনোর পর পায়ে হেঁটে যাওয়ার একমাত্র বিকল্প মোটরসাইকেল। স্বাভাবিকভাবেই প্রান্তিক এই চরের বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে নেই মোটরসাইকেল। যাতায়াতের এই সীমাবদ্ধতাকেই কাজে লাগিয়েছেন এখানকার তরুণরা। মানুষসহ মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে মোটরসাইকেলই এখন তাদের আয়ের প্রধান উৎস।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হরিঘাটে যেতে প্রথমে হরিরামপুর উপজেলা সদরের আন্ধারমানিক ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পাড়ি দিতে হয় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার নৌপথ। পদ্মার অথৈ পানি আর ঢেউ অতিক্রম করে পৌঁছাতে হয় লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের পদ্মা পাড়ের হরিণাঘাটে। সেখান থেকে চরের মানুষদের নিজ নিজ গন্তব্যে পোহাতে হয় হয় চরম ভোগান্তি।
স্থানীয়রা বলছেন, সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা এতটাই ভঙ্গুর যে পায়ে হাঁটা ছাড়া সাধারণ মানুষদের কাছে বিকল্প নেই বললেই চলে। শুষ্ক মৌসুমে চরের আঁকাবাঁকা ও ভাঙা রাস্তা ধরে চরবাসী যাতায়াত করতে পারলেও বর্ষা কিংবা ঝড়-বৃষ্টির সময় দুর্ভোগের মাত্র বেড়ে যায় শতগুণ। এমন পরিস্থিতিতে মোটরসাইকেল থাকলেই কেবল যাতায়াতের এই ভোগান্তি থেকে রেহাই মেলে কিছুটা।
পদ্মা ডিঙিয়ে সরেজমিনে হরিণাঘাট গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার পাড়ে ভাড়ায় চালিত শতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে বসে আছেন তরুণরা। দুয়েক ঘণ্টা পরপরই ঘাটে ভিড়ছে একটি করে ট্রলার। সেই ট্রলারেই শত যাত্রী, তার সঙ্গে গাদাগাদি করে রাখা নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ সব ধরনের মালামাল। ঘাটে নৌকা ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় হৈ হুল্লোড়। মোটরসাইকেলের চালকরা যেমন যাত্রী পাওয়ার জন্য হাঁকডাক শুরু করেন, তেমনি যাত্রীরাও দ্রুত মোটরসাইকেল পেতে তোড়জোড় শুরু করেন।
কথা হয় মোটরসাইকেলচালক বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। জানালেন, বেশিরভাগই স্কুলের বারান্দায় পা রাখেননি। বাবা-চাচার সঙ্গে কৃষিকাজ কিংবা মাছ ধরতেন একটা সময়। গত একযুগে এসব তরুণদের অনেকেই ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে কর্মসংস্থানের পথ করে নিয়েছেন। অনেকে মোটরসাইকেল কিনে নিজেই চালাচ্ছেন, যাত্রী পরিবহনে কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ অন্যের কাছ থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে অনেকটা রাইড শেয়ারিংয়ের আদলে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বসন্তপুর চরের তরুণ রিয়াজুল। মা-বাবা, স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন ছিল নিত্যসঙ্গী। বছর সাতেক আগে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলকে আয়ের পথ হিসেবে বেছে নেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হরিণাঘাট থেকে যাত্রী আনা-নেওয়া করেন। তাতে সংসার চালানো কিছুটা হলেও সহজ হয়েছে।
রিয়াজুল সারাবাংলাকে বলেন, আগে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হতো। এখনো কষ্ট হয়। তবু দিন চলে যাচ্ছে। তবে বছরের চার-পাঁচ মাস মোটরসাইকেল চালাতে পারলেও বৃষ্টি-বাদলের দিনগুলোতে বন্ধ রাখতে হয়। কারণ রাস্তাঘাটে একেবারেই চলাচলের অবস্থা থাকে না।
আরেক চালক রেজাউল করিম বলছিলেন, চরের মানুষের দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই। অভাব-অনটনে রয়েছে চরের বেশিরভাগ মানুষ। বাইরের মানুষজন একবার চরে এলে দ্বিতীয়বার আসার নাম নেবে না। আমরা যদি মোটরসাইকেল ভাড়ায় না চালাতাম, তাহলে মানুষজনকে মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটতে হতো। মোটরসাইকেলই এখানকার মানুষের ভরসার নাম।
মোটরসাইকেল চালক বাবুল মিয়া জানালেন, খুব কষ্টে একটি মোটর সাইকেল কিনেছেন। এই বাহনই তার পরিবারে দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা করছে। সারাদিন মানুষ আনা নেওয়া করে ৫০০ টাকার মতো উপার্জন হয়।
এলাকাবাসীও বলছেন, মোটরসাইকেলে যাতায়াতের ব্যবস্থা তাদের জন্য একরকম আশীর্বাদই হয়ে এসেছে। কারণ দিনের পর দিন মাইলকে মাইল পায়ে হাঁটাই ছিল তাদের নিয়তি। এখন মোটরসাইকেল থাকায় তাদের যাতায়াতের দুর্ভোগ অনেকটাই কমেছে। যাতায়াতের সময়ও কমেছে অনেকটাই।
জানতে চাইলে আজিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, পদ্মার চরে মোট ইউনিয়ন চারটি। এর মধ্যে কেবল আমার আজিমনগর ইউনিয়নেই জনসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এখানকার মানুষ মূলত নিম্নবিত্ত। তাদের আয়ের প্রধান উৎস কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। তবে গত কয়েক বছর ধরে চরের তরুণরা ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতে শুরু করেছে। চরের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা থাকায় মোটরসাইকেলই এখানকার মানুষের যোগাযোগের প্রধান ভরসা। ফলে তরুণরা যেমন মোটরসাইকেল থেকে আয় করছে, তেমনি এলাকাবাসীও যাতায়াতে সুবিধা পাচ্ছে।
চেয়ারম্যান বিল্লালও বলছেন, বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে এখনো যাতায়াতের অপ্রতুলতা ভোগান্তি বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে কাঁদা পেরিয়ে হাঁটার উপায় থাকে না, মোটরসাইকেলও চালানো যায় না। তখন যোগাযোগের একমাত্র বাহন নৌকা। অনেকেই তখন নৌকায় মানুষ ও মালামাল পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
সারাবাংলা/এএম/টিআর