বেসরকারিতে করোনা পরীক্ষার খরচ এখনো কেন ৩৫০০?
১৪ অক্টোবর ২০২১ ২৩:৫৭
ঢাকা: দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে বেসরকারি ল্যাবে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষার খরচ কমিয়ে আনার দাবি রয়েছে শুরু থেকেই। একবার সেই খরচ কমানো হলেও এখনো বেসরকারি ল্যাবে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করতে চাইলে খরচ করতে হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। আর বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে সেই খরচ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৩৫০০ টাকায়। অথচ এর মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসগামীদের জন্য ১৬০০ টাকায় করানো হচ্ছে নমুনা পরীক্ষা। বিমানবন্দরে বেসরকারি ল্যাবগুলো নতুন করে পিসিআর মেশিন স্থাপন করার পরও ১৬০০ টাকায় নমুনা পরীক্ষা করাতে পারলে সাধারণ মানুষের জন্য সেই খরচ কেন ৩ হাজার থেকে ৩৫শ টাকা— এ প্রশ্নও উঠেছে।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের শুরুতে বিশ্বব্যাপী আরটি-পিসিআর কিটের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। দামও ছিল ২৮শ টাকা পর্যন্ত। সেই কিটের দাম এখন হাজারের নিচে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কমিয়ে আনা উচিত। এক্ষেত্রে তারাও বিমানবন্দরে নমুনা পরীক্ষার খরচের বিষয়টির কথা তুলে ধরছেন। বলছেন, এই খরচ দেড় হাজারে নেমে এলে অনেকেই নমুনা পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত হবেন।
এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নমুনা পরীক্ষার খরচ কমানোর কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। আর স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সম্প্রতি তারা নমুনা পরীক্ষার এই খরচ কমাতে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলেও কোনো জবাব আসেনি।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শর্ত মানতে গিয়ে নমুনা পরীক্ষার জন্য ছয়টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের অনুমতি দেয় সরকার। সেখানে প্রবাসীদের নমুনা পরীক্ষার খরচ চূড়ান্ত করা হয় ১৬০০ টাকা, সেটি অবশ্য দিয়ে দিচ্ছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে বিমানবন্দরের বাইরে এখনো বেসরকারি ল্যাবগুলোতে এই খরচ ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তবে সার্ভিস চার্জসহ নানা ধরনের খরচ দেখিয়ে বেসরকারি ল্যাবগুলোর কোনো কোনোটি বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার খরচ নিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। এত টাকা নিয়েও আবার কিছু ল্যাবে এক কিটে দুই নমুনা পরীক্ষা করার ঘটনাও আছে!
দেশে বেসরকারি ল্যাবগুলোকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার সময় খরচ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকা। বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। ওই সময় আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষার খরচের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কিটের দামকে এত বেশি খরচের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। ওই সময় কিটের সরবরাহ যেমন পর্যাপ্ত ছিল না, তেমনি একেকটির দামও আড়াই হাজার টাকা থেকে ২৮শ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়েছে।
সমেয়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলেছে। পিসিআর কিটের এখন কোনো সংকট বিশ্বের কোথাও নেই। কিটের দামও নেমে এসেছে হাজারের নিচে। কিটের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে নমুনা পরীক্ষার খরচও বিভিন্ন দেশে কমেছে দফায় দফায়। ভারতেই যেমন মহারাষ্ট্রে ৪ হাজার রুপি থেকে এই খরচ কেন্দ্রে গিয়ে করলে সর্বনিম্ন ৫০০ রুপিতে নেমে এসেছে। উত্তর প্রদেশে আবার এই খরচ ৭০০ রুপি। গুজরাটে ৯শ থেকে ১ হাজার রুপিতে নেমে এসেছে নমুনা পরীক্ষার খরচ।
কিটের দাম কমে হাজারের নিচে নামলেও বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কেন কমছে না— এ প্রশ্ন তুলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। সরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষা বাড়লেও বেসরকারি ল্যাবে খরচ কমলে স্বল্প সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা নমুনা পরীক্ষায় বেশি আগ্রহী হবেন।
দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও বিএমডিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিটের দাম কমে যাওয়ায় আগের খরচে বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক। কিটের দাম ১ হাজার টাকা হলেও নমুনা পরীক্ষার খরচ দেড় হাজার টাকায় নামিয়ে আনা উচিত। তাছাড়া বিমানবন্দরে তো ১৬০০ টাকায় নমুনা পরীক্ষা করছে বেসরকারি ল্যাব। বাইরে কেন বেশি লাগবে?
প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে জানতে হবে কতসংখ্যক মানুষের মাঝে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতেই হবে। সরকার ১০০ টাকায় নমুনা পরীক্ষা করে দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি এসব স্থানের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। সেক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কমানো জরুরি। কিট এখন স্বাভাবিক পণ্যে পরিণত হওয়ায় এটি নিয়ে জটিলতা থাকা উচিত না।
নমুনা পরীক্ষা নিয়ে নানা অভিযোগ এবং কিটের দাম কমলেও বেসরকারি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার খরচ কেন কমছে না— বেসরকারি ল্যাবগুলোর কর্মকর্তারা এমন প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এটি সরকারের বিষয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হবে।’
অধিদফতর সূত্র বলছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ক একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেনের সঙ্গেও সারাবাংলা যোগাযোগ করতে পারেনি।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর