ঢাবির হলগুলোতে ফের সচল ছাত্রলীগের ‘গেস্ট রুম’
১৫ অক্টোবর ২০২১ ২২:৩৫
ঢাবি: দীর্ঘ দেড়বছর পর সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো। দেড় বছর বন্ধ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষাকৃত নবাগত শিক্ষার্থীদের ‘গেস্ট রুম’ ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। হলগুলো খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ফের চালু হয়েছে ছাত্রলীগের ‘গেস্ট রুম’ প্রথা।
করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো বন্ধ হওয়ার পর খুলে দেওয়ার সময় হলগুলো থেকে গণরুম সংস্কৃতি বিলুপ্তির কঠোর পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু হল খোলার পর সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। খুলে দেওয়ার পর আগের মতোই হলগুলোতে অছাত্রদের উঠে পড়তে দেখা যায়। ফল হিসেবে আবাসন সংকটে গণরুমেই উঠতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের।
সাধারণত গণরুমের শিক্ষার্থীদের নিয়েই বাধ্যতামূলক ‘গেস্ট রুম’ প্রোগ্রাম চলে, সেই হিসেবে ফের গেস্ট রুমও চালু করতে পেরেছে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ।
গেস্ট রুম কী
‘গেস্ট রুম’ মূলত ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন পরিচালিত একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এতে সাপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসেন দ্বিতীয় বর্ষের সেসব শিক্ষার্থী, যারা ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে এখন গেস্টরুম পরিচালনা করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের হল শাখার নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকটকে পুঁজি করে ছাত্রলীগ ‘গেস্ট রুম’ কালচার নামে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করায় বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্র ও ছাত্রী হল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমোট ১৭টি হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের ‘গেস্ট রুম’ কালচার চলমান আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের এক শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গেস্ট রুমে আমাদের বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকতে হয়। উপস্থিত না থাকলে হল থেকে বের করে দেওয়ার মতো শাস্তি পর্যন্ত দেওয়া হয়। সপ্তাহে দুই বা তিনদিন।’
কী হয় গেস্টরুমে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর ভর্তি হওয়া নতুন সব শিক্ষার্থীকে অ্যালটমেন্ট দেওয়া হলগুলোতে আবাসন সুবিধা দেওয়ার সক্ষমতা কর্তৃপক্ষের নেই। এই সূত্রে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন রাজনৈতিক ক্ষমতায় হলের কয়েকটি রুম ‘দখল’ করে সেখানে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করেন। এই সুবিধার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আসা শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ওই সংগঠনের নেতাকর্মীদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এসব নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় ‘গেস্ট রুম’ প্রোগ্রামে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিনিয়রদের বাধ্যতামূলক সালাম দেওয়া, সালাম দিয়ে হ্যান্ডস (করমর্দন) করা, নিয়মিত রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের নিয়ম করে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এসব নিয়মের ব্যতয় ঘটলেই সেটাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। পরবর্তী দিন ‘অপরাধ’ করা শিক্ষার্থীকে গালাগাল করা থেকে শুরু করে চড়-থাপ্পড় দিয়ে ‘শাসন’ করার ঘটনাও ঘটে।
ছাত্রলীগের ‘যন্তরমন্তর ঘর’ ঢাবি হল গেস্টরুম, চলছে নবীন নির্যাতন
বিজয় একাত্তর হলের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘মনে করেছিলাম, করোনার পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে অন্তত গেস্ট রুম শাসনের অবসান ঘটবে। কিন্তু এসে দেখি আগের মতোই রয়ে গেছে সব।’
বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, হ্যান্ডশেইক বা করমর্দনকে গেস্ট রুমে বলা হয় ‘হ্যান্ডস’। নিয়ম হলো, সিনিয়রের সঙ্গে করমর্দন করার সময় কোনো ধরনের ‘শেইক’ বা ঝাঁকি দেওয়া যাবে না। তাই ‘হ্যান্ডশেইক’ শব্দটি গেস্টরুম প্রক্রিয়ায় পরিচিতি পেয়েছে ‘হ্যান্ডস’ নামে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের এক শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার আগে আমি এক সিনিয়র ভাইকে নিয়ম অনুযায়ী সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করেছিলাম। পরে সেদিন রাতে গেস্ট রুমে তিনি অভিযোগ করেন, আমি করমর্দনের সময় ঝাঁকি দিয়েছি! আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হয়।
ছাত্রলীগ যা বলছে
সম্প্রতি গেস্ট রুম কালচারকে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নতুন নামে আখ্যা দিতে দেখা গেছে। গেস্ট রুম প্রক্রিয়ায় পূর্বের সব কার্যক্রম বলবৎ থাকলেও এখন এটিকে ‘পাঠচক্র’ বলছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক হুসেইন সাদ্দাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘হলগুলোতে যাতে কেউ অপরাজনীতি করতে না পারে, সেইদিক আমরা খেয়াল রাখছি। কেউ যদি এমন করে, তবে তার বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। কর্মীদের কাছে পৌঁছার উপায় হিসেবে তারা আদর্শিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে, পাঠচক্রের আয়োজন করতে পারে।’
করোনা পরিস্থিতির মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রায় প্রত্যেক হলের গণরুমগুলোতে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ‘গেস্ট রুম’ অনুষ্ঠানের নাম করে শিক্ষার্থীদের ফের জড়ো করার প্রক্রিয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সাদ্দাম হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে যতোটুকু সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতে হবে।’
এদিকে গেস্টরুম কালচার প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসকে দফায় দফায় ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলে তারও জবাব দেননি তিনি।
সারাবাংলা/আরআইআর/এমও