হলো না আর ‘সুন্নতে খৎনা’, উৎসব মুছে গেল কান্নায়
১৭ অক্টোবর ২০২১ ২৩:১৪
ময়মনসিংহ: ‘নানা ব্যস্ততায় কোরবানির ঈদে বাড়িতে যাওয়া হয় নাই, আর নাতি আব্দুল্লাহর মুসলমানি করানো সম্ভব হয় নাই। এবার গ্রামের বাড়িতে সবাই একসঙ্গে যাইতেছিলাম। ধুমধামে এলাকাবাসীকে দাওয়াত করে আব্দুল্লাহর সুন্নতে খৎনার আয়োজন ছিলো। কিন্তু কপালে আর সইল না। পরিবারের বাবা, মা, ছোটবোনসহ আব্দুল্লাহ বাস দুর্ঘটনায় দুনিয়া ছেড়েই চলে গেল। এখন বাড়ি গিয়ে বড় ভাইকে কি জবাব দিমু।’
বিলাপ করতে করতে এই কথাগুলোই বারবার বলছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের চেলেরঘাট ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ট্রাকের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় একই পরিবারের নিহত ৪ জনের স্বজন আব্দুর রশিদ।
আব্দুর রশিদ জানান, নিহত ফজলুল হক তার আপন বড় ভাই কমর উদ্দিনের ছেলে। সবাই একসঙ্গেই থাকেন। সুযোগ পেলেই তারা বাড়িতে আসেন। করোনার কারণে কোরবানির ঈদে বাড়ি আসা হয়নি। ৯ বছর বয়সের নিহত আব্দুল্লাহ প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি আর ছোটবোন আজমিনা (৬) প্রথম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। ভাতিজা ফজলুর বড় সখ ছিল গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীকে দাওয়াত করে ছেলের মুসলমানি দেওয়ার।
অন্যদিকে ত্রিশাল থানা চত্বরে পরিবারের চারজনকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন নিহত ফজলুর বোন লাকি আক্তার। পরিবারের চারজনকে হারিয়ে বিলাপে দিশেহারা হয়ে বারবার বলছিলেন, ‘আমারে থুইয়া কই গেলা ও ভাই গো, ও ভাবি গো। এই মনেরে কি দিয়া বুঝামু গো আল্লাহ। চারজন মিইল্যা একলগে কই গেল গা’।
পরিবারের স্বজনরা জানান, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইলে ভাড়া বাসায় সপরিবারে থাকতেন ময়মনসিংহের ফুলপুরের কমর উদ্দিনের ছেলে ফজলুল হক। সেখানে আচারের ব্যবসা করতেন তিনি। করোনার ও নানা ব্যস্ততার কারণে গত ঈদে বাড়িতে আসা হয়নি। তাই দীর্ঘদিন পর পরিবারের সবাই মিলে বাড়ি আসছিলেন তারা। পরিকল্পনা ছিলো বাড়িতে এসে ছেলে আব্দুল্লাহর মুসলমানি দেওয়ার। তবে পথেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল স্ত্রী, দুই সন্তানসহ ফজলুল হকের।
উল্লেখ্য, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চেলেরঘাটে দাড়িয়ে থাকা বালিবাহী ড্রাম ট্রাককে যাত্রীবাহী বাস সজোরে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের চারজনসহ ৭ জন নিহত ও আহত হয় অন্তত ১০ জন। শনিবার (১৬ অক্টোবর) বেলা ৩টার দিকে শেরপুরগামী রহিম পরিবহন এই দুর্ঘটনায় পড়ে।
নিহতরা হলো ফুলপুরের ছনধরা ইউনিয়নের মড়লবাড়ির ফজলুল হক (৩৫), তার স্ত্রী ফাতেমা (২৮), ছেলে আব্দুল্লাহ (৯) ও মেয়ে আজমিনা (৬)। বাকি তিনজন ভালুকার নিশিন্দা এলাকার হেলেনা আক্তার (৪০), শেরপুর নকলার নজরুল (৫৫) ও মিরাজ (৩৫)।
একই পরিবারের চারজন মারা গেলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছেন ফজলুল হকের চাচা রফিক মন্ডল। দুর্ঘটনা কবলিত বাসে থাকা রফিক মন্ডল বলেন, ‘আমারও আজ বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তাদের সঙ্গে আমিও বাসের পেছনের দিকে ছিলাম। তবে ভালুকা আসার পর সামনের সিটের একজন নেমে গেলে আমি সামনে চলে যাই। আর তাতেই প্রাণে বেঁচে গেছি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আমিও এখন অপেক্ষা করছি ভাতিজার পরিবারের লাশ নেওয়ার জন্য।’
ত্রিশাল মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইন উদ্দিন জানান, দুর্ঘটনার পর কিছু সময় সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিলো। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত হতাহতদের উদ্ধার করে। বাস ও ট্রাকের চালক পলাতক থাকলেও তাদের ধরতে অভিযান চলছে। রাতেই স্বজনদের কাছে নিহতদের লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
লাশগুলো নিজ গ্রাম ফুলপুর ছনধরা মড়লবাড়িতে পৌঁছলে সেখানে শুরু হয় মাতম। স্বজনদের আহাজারি-বিলাপে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। রোববার সকালে ছনধরা হাতপাগলা স্কুল মাঠে জানাজা শেষে স্থানীয় গোরস্থানে তাদের দাফন করা হয়েছে।
সারাবাংলা/এমও