প্রতিবাদে মুখর শিল্পী-সাহিত্যিকরা, মানুষরূপী অসুর বধের আহ্বান
১৯ অক্টোবর ২০২১ ২০:০৬
ঢাকা: দেশব্যাপী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চক্রান্ত রুখে দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার দাবি করা হয়। বক্তারা বলেন, মানুষরূপী অসুর যারা আছে তাদের বধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রত্যেককে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা, ওয়াজ মাহফিলে সাম্প্রদায়িক ও নারী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ, পাঠ্যপুস্তক থেকে সাম্প্রদায়িক পাঠ বিলুপ্ত করাসহ সর্বমোট ৮ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়।
সমাবেশস্থলে রঙ-তুলি হাতে স্লোগান লিখে প্রতিবাদ জানান চিত্রশিল্পীরা। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘খুব দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমি মনে করি, একটি সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত হয়েছে। যেটাকে এথনিক ক্লিনজিং বলে। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত মানে আপনার-আমার ওপর আঘাত, বাংলাদেশের সংবিধানের ওপর আঘাত। কারণ মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, ভিন্নমতের মানুষ ও ভিন্ন ধর্মের মানুষের অধিকার যখন ক্ষুণ্ণ করা হয়, তখন লেখক হিসেবে আমার অধিকারও ক্ষুণ্ণ হয়। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।’
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে পঞ্চগড়-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান বলেন, ‘কোনো মুসলমান যেমন মন্দিরে আজান দেবে না, তেমনি কোনো হিন্দুও মন্দিরে কোরাআন রাখতে পারে না। যারা এই কাজ করেছে, তারা মানুষরূপী অসুর। চলুন, আজ এই সমাবেশ থেকে ঘোষণা দিই— এসব মানুষরূপী অসুরদের বধ করতে হবে। আমরা মাঝে মাঝে এদের ক্ষমা করেছি। কিন্তু এখন প্রমাণ হয়ে গেছে, এরা মানুষরূপী অসুর। এদের বধ করতেই হবে।’
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানা বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে কেন আজ আমার মূর্তির ওপর আঘাত আসে? কেন আজ আমি আমার মা’কে শান্তিতে বিসর্জন দিতে পারি না? এই দুঃখ কোথায় রাখব?’
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সমাবেশে সংহতি জানিয়ে সংগঠনটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সংগীতা ইমাম বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনায় আমরা এখানে এসে দাঁড়াই। কিন্তু এই যে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো হচ্ছে, তার কোনো বিচার হচ্ছে না। রামু থেকে নাসিরনগরের ঘটনাগুলোর বিচার যদি হতো, তবে আজকে চাঁদপুর-নোয়াখালী-কুমিল্লায় এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটত না। রাষ্ট্রক্ষমতা ঠিকঠাক কাজ করছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে না। চোর পালালে যেমন বুদ্ধি বাড়ে, ঠিক তেমনি পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় তিন-চার ঘণ্টা পর।’
একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক জুলহাস নুর বলেন, ‘আমি একজন সংবাদকর্মী। আমরা নিউজরুমে কাজ করি। যখন এ ধরনের হামলার ঘটনাগুলো আমাদের কাছে আসে এবং এগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়, তখন আমরা ভীষণভাবে মুষড়ে পড়ি। আমরা যখন এখানে দাঁড়িয়ে আছি, এর আগেই ঘটে গেছে হাজীগঞ্জ, চৌমুহনী, পীরগঞ্জের ঘটনা। এসব ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে, তারা বারবার ঘটিয়ে চলেছে। এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধে যে গণপ্রতিরোধ হওয়া দরকার, সরকার-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনীতিবিদদের যা করা দরকার, আমরা কি তা ঠিকঠাক করছি?’
চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক চিত্রশিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা সবাই এখানে সমাবেত হয়েছেন। এই সমাবেত হওয়াটা এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ কখনো পরাজিত হতে পারে না। এই দেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা আছে মানুষ আর পিশাচে। যারা এসব ঘটাচ্ছে, তারা পিশাচ আর আমরা মানুষ। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, কালো-সাদা হিসেবে দেখি না।’
সমাবেশে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আট (আট) দফা দাবি উত্থাপন করেন কথাশিল্পী স্বকৃত নোমান।
বিক্ষোভ সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন গৌরব একাত্তরের সাধারণ সম্পাদক এফএম শাহীন, আওয়ামী যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুস্তাফিজ বিপ্লব, কথা সাহিত্যিক আহমদ মোস্তফা কামাল, লেখক ও গবেষক চঞ্চল আশরাফ, অভিনয়শিল্পী মৌটুসী বিশ্বাস, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি মাসুদ পথিক, কবি ঝর্ণা রহমান, কবি টোকন ঠাকুর, কথা সাহিত্যিক পারভেজ হোসেন, আবৃত্তিশিল্পী মাসুম আজিজুল বাশার, রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী ড. মকবুল হোসেনসহ অন্যরা।
ছবি: হাবিবুর রহমান, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আরআইআর/পিটিএম