টাকা আত্মসাতের মামলার পর ছুটিতে যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব
১৯ অক্টোবর ২০২১ ২০:২৮
যশোর: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের মামলায় আসামি হওয়ার পর ছুটিতে গেছেন যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন ও সচিব অধ্যাপক এ এম এইচ আলী আর রেজা। অন্যদিকে তদন্ত রিপোর্ট দিতে আরও তিনদিনের সময় প্রার্থনা করেছে শিক্ষা বোর্ডের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি। প্রধান অভিযুক্ত হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের বক্তব্য নিতে না পারায় এ সময় প্রার্থনা করা হয়েছে।
দুদক বলছে, শিগগিরই তারাও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করবে এবং টাকার সর্বশেষ গন্তব্য পর্যন্ত তদন্ত করা হবে। সেক্ষেত্রে আসামির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক। এদিকে গত সোমবার দুদকে মামলা হওয়ার পর শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন কক্ষে, চায়ের দোকানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিষয়টি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কর্মচারীদের অনেকেই চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি তুলেছেন।
সোমবার (১৮ অক্টোবর) দুদকের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। দুদক উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম, ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক শেখ শরিফুল ইসলাম বাবু ও শাহী লাল স্টোরের মালিক আশরাফুল আলম।
বোর্ড সূত্র জানায়, গত ৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বোর্ডের অডিটর মো. আব্দুস সালাম আজাদ ও উপপরিচালক এমদাদুল হক শিক্ষা বোর্ড সচিব অধ্যাপক এ এম এইচ আলী আর রেজার কাছে একটি ফাইল উপস্থাপন করেন। যেখানে প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে শিক্ষা বোর্ডের অ্যাকাউন্ট থেকে ৯টি চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ভ্যাট ও আয়কর খাতের মাত্র ১০ হাজার ৩৬ টাকার স্থলে এই টাকা উত্তোলন করে দু’টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো, ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও শাহী লাল স্টোর।
আরও পড়ুন: যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান-সচিবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর জানা যায়, চেয়ারম্যান সচিবের স্বাক্ষরিত চেকে এই টাকা উত্তোলিত হয়েছে। পরে হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম সমস্ত অপরাধ নিজের কাঁধে নিয়ে জবানবন্দি দেন। তিনি ১৫ লাখের বেশি টাকা ফেরত দিয়ে অবশিষ্ট টাকা ফেরত দেওয়ার জন্যে সময় প্রার্থনা করেন।
অন্যদিকে, অভিযুক্ত ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের পক্ষ থেকে বোর্ড চেয়ারম্যান ও উপসহকারী প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়। একপর্যায়ে শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে যশোরের দুদুক কার্যালয়ে মামলা করার জন্যে আর্জি জানানো হয়। সে আরজির পর গত ১০ অক্টোবর দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম থেকে অভিযান পরিচালিত হয়। পরে সোমবার দুদক কার্যালয় এ আরজি মামলা হিসেবে রেকর্ড করে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ২০২০-২১ অর্থবছরের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট থেকে দেখা যায়, শিক্ষা বোর্ডের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এসটিডি হিসাব খাতে নয়টি চেক পরিশোধিত হয়। শিক্ষা বোর্ডে সংরক্ষিত চেকের রক্ষিত অংশে উল্লেখিত টাকার পরিমাণের সঙ্গে ব্যাংকে পরিশোধিত টাকার মিল নেই। ইস্যু করা চেকগুলোর বিপরীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে অর্থ পরিশোধিত হয়নি। অথচ ওই চেকের বিপরীতে জালিয়াতি করে দু’টি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে।
শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্ট্রার নিরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান দু’টি ওই টাকার বিপরীতে শিক্ষা বোর্ড স্টোরে কোনো মালমাল সরবরাহ করেনি। নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষা বোর্ডে মালামাল ও সেবা সরবরাহের লক্ষ্যে শিক্ষা বোর্ডের সচিবের সই করা কার্যাদেশ পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্টোরে মালামাল সরবরাহ করে। এরপর শিক্ষা বোর্ডের সচিবের কাছে মালামালের চালান ও বিল ভাউচার দাখিল করে। এরপর শিক্ষা বোর্ডের সচিব মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য চালান ও বিলের ওপর স্টোর কিপারকে মার্ক করে স্টোরে পাঠান। অথচ জালিয়াত চক্র ও প্রতিষ্ঠান দুটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কৌশলে অন্য বিল হতে ভ্যাট ও আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার লক্ষ্যে ইস্যু করা চেকগুলোর মুড়ির নম্বর এবং তারিখের সঙ্গে মিল রেখে চেক জালিয়াতি করে বোর্ড তহবিল হতে অর্থ উত্তোলন করে।
এদিকে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুশি। তারা জানান, দীর্ঘ দিন শিক্ষা বোর্ডে একটি দমবন্ধ ও অস্বস্তিকর পরিবেশে ছিল। অনেকেই নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। এখন অন্তত স্বাভাবিক চাকরিবিধিতে শিক্ষা বোর্ড চলবে।
দুদকে মামলা হওয়ার পরও চেয়্যারম্যান-সচিবরা স্বপদে থাকতে পারবেন কিনা এমন প্রশ্নে সিবিএ সাধারণ সম্পাদক ও জেলা শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু জানান, সরকারি চাকরি বিধিতেই রয়েছে অভিযুক্ত তদন্ত চলাকালে স্বীয়পদে থাকতে পারেন না, তাহলে তদন্ত কাজে ব্যঘাত ঘটে। এ সময় তিনি সাময়িক বহিষ্কার থাকবেন। পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে আবার নিজ পদে ফিরতে পারবেন।
তবে বোর্ড চেয়ারম্যান. প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন জানান, অভিযোগ হতেই পারে, এতে দায়িত্ব পালনে বাধা নেই। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তখন যথাযথ ব্যবস্থা হতে পারে।
এদিকে, দুদুক গত ১০ অক্টোবর অনুসন্ধান পর্যন্ত ৯টি চেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা জালিয়াতির ঘটনা পায়। পরবর্তীতে আরও একটি চেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ১০ টাকা উত্তোলনের ঘটনা ধরা পড়ে। সেটিও ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের নামে এবং তাদের অ্যাকাউন্টে এই টাকা জমা হয়।
দুদক যশোরের উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, ‘তদন্তে এটি মামলার সঙ্গে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। তবে প্রথম অনুসন্ধানে পাওয়া ওই ৯টি চেকের বিষয় ছিল, তাই সেটিকে ভিত্তি করেই মামলা হয়েছে।’
সারাবাংলা/এএম