সংক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক, দূরত্ব যেন না হয়— রানা দাশকে নওফেল
২১ অক্টোবর ২০২১ ১৮:২৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষাপটে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে প্রায় দেড়ঘণ্টা বৈঠক করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এ সময় রানা দাশগুপ্ত হামলার প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ ও সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে উপমন্ত্রীকে জানান। জবাবে উপমন্ত্রী নওফেল হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, সংক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক, তবে সরকার এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো সম্প্রদায়ের যেন দূরত্ব তৈরি না হয়।
বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) দুপুর ১টার দিকে শিক্ষা উপমন্ত্রী নগরীর দেওয়ানজী পুকুর লেইনে রানা দাশগুপ্তের বাসায় যান। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত একান্তে বৈঠক সেরে দু’জন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের সিদ্ধান্তে উপমন্ত্রী নওফেল অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের কাছে গেছেন বলে জানা গেছে। দেশে যাতে একটি সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় থাকে, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করতেই তিনি সেখানে যান।
বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে রানা দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে, সেটার বিষয়ে আলোচনা করতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আমার এখানে এসেছেন। আমি উপমন্ত্রীর কাছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যারা ক্ষুব্ধ, তাদের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করেছি। আমরা দু’জন মিলে করণীয় কি হওয়া উচিত, এ নিয়েও আলোচনা করেছি এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে, সম্প্রীতিতে, কীভাবে আমরা ভাই-ভাই হিসেবে বসবাস করতে পারব, সে বিষয়ে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তার বক্তব্য এবং আমার বক্তব্যের মধ্যে আদৌ কোনো ভিন্নতা ছিল না এই ইস্যুতে।’
‘আমি উনাকে বলেছি যে, সাম্প্রতিক ঘটনায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ক্ষোভ এবং এতে করে সরকারের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমি এ কথাগুলো স্পষ্টভাবে বলেছি। মাঠে আমি যা বলেছি, সেগুলো উপমন্ত্রীকেও বলেছি। এটাও বলেছি, এই ক্ষোভ এবং দূরত্ব যদি অব্যাহত থাকে, এটা কারও জন্য শুভ হবে না, দেশের জন্য তো নয়ই। অতএব করণীয় কী তা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল এবং সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার জন্য আমি তাকে অনুরোধ করেছি।’
বৈঠকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে প্রশাসনের গাফিলতির বিষয়ও উঠে আসে বলে রানা দাশগুপ্ত জানান। তিনি বলেন, ‘আমি উপমন্ত্রীকে বলেছি, সর্বত্রই প্রশাসনের গাফিলতি আছে এবং রাজনৈতিক দলেরও গাফিলতি আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের পাশে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা এবং কর্মীকে দেখা যায়নি। একইসঙ্গে বলেছি, যদি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কেবল পুলিশের ওপর ছেড়ে দিই, সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব শুধু তাদের উপরই দিই- এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাদের সঙ্গে জনগণের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এখন বিষয়গুলো কীভাবে করবে, সেটা সরকার এবং রাজনৈতিক দলকেই নির্ধারণ করতে হবে।’
২৩ অক্টোবর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রঘোষিত গণঅনশন ও গণঅবস্থান এবং বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লায় এসে সংহতি জানানোর জন্য রানা দাশগুপ্ত উপমন্ত্রী নওফেলকে অনুরোধ করেন।
এদিকে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনের সাংসদ উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি শ্রদ্ধেয় রানা দাশগুপ্তের উদ্বেগ এবং পর্যবেক্ষণগুলো শুনেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শান্তি ও সম্প্রীতির একটা বার্তা দিয়েছেন। শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ আমরা করছি। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়া যদি না থাকে, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা না থাকে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন। এটা প্রধানমন্ত্রীর বার্তা। এই বার্তা নিয়েই আমি এসেছি। আমাদের পক্ষ থেকে সম্প্রীতির বার্তা আমরা অবশ্যই দিয়ে যাব।’
‘কিছু ক্ষোভের কথা তিনি (রানা দাশগুপ্ত) বলেছেন। দেশের যেকোনো নাগরিক সংক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ অবশ্যই করতে পারেন। এটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি আমরা অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল। পাশাপাশি আহ্বানও জানাই, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় সংক্ষুব্ধ সকল পক্ষকে আমাদের সঙ্গে একসাথে কাজ করার জন্য। সংক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, যে ঘটনা ঘটেছে, এতে সংক্ষুব্ধ হবেন সেটাই স্বাভাবিক।’
দূরত্ব তৈরি না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কি সংক্ষুব্ধ নয়? আমরা সরকারে থাকা অবস্থায় অপরাজনৈতিক শক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি যে কাজটি করছে সেটাতে তো আমরাও সংক্ষুব্ধ। আমাদের দলের সংক্ষুব্ধ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তার জন্যই আমরা সম্প্রীতি সমাবেশ করছি। আমরা খুবই ক্ষুব্ধ। তার জন্যই আমরা বিক্ষোভ করছি, আমরা প্রতিবাদ করছি। প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিয়েছি।’
‘সুতরাং আমি মনে করি না, আমাদের দলের সঙ্গে কোনো সম্প্রদায়ের কোনো দূরত্ব আছে। হ্যাঁ সংক্ষুব্ধ অবশ্য থাকবে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ, আঞ্চলিক পরিস্থিতি যদি দেখি, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যদি দেখি, বাংলাদেশে যে ধরনের তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের আছে, তাতে অন্য জায়গা থেকে পরিস্থিতি খারাপ সেটা বলা যাবে না। তাই বিচলিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না।’
রাজনৈতিক দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের গাফেলতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটাও সত্য যে, রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্বের বিষয়টি সেভাবে ভাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি একটি সুনির্দিষ্ট এখতিয়ার। সেটি আমি রানা দাশগুপ্ত মহোদয়কে বলেছি। এটার একটা চ্যালেঞ্জ আছে, সম্পদের সীমাবদ্ধতার বিষয়ও আছে। চট্টগ্রাম শুধু নয়, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং রংপুরসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় অনেক ঘটনা ঘটেছে। সরকার সেগুলো নিয়ে শতভাগ তৎপর আছে। আমরা কোনোভাবেই বলতে পারব না যে, এখানে কোনো ধরনের নির্লিপ্ততা আছে। আমরা কিন্তু শতভাগ সচেষ্ট আছি। ইতোমধ্যে অনেক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও গ্রেফতার করা হয়েছে।’
বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি রানা দাশগুপ্ত মহোদয়কে বলেছি- তিনি একজন আইনজীবী, তিনি ভালো বুঝবেন। দীর্ঘসূত্রিতা থাকলেও বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে যাওয়া আমাদের সম্ভব নয়। এই বাংলাদেশেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচারও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছিল ২১ বছর পর। সুতরাং বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতাটা আছেই। আমরা প্রশাসনিক সকল ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আশ্বস্ত করতে চাই, বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে, যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আমরা সৃষ্টি করতে পেরেছি, যার দরুণ বাংলাদেশে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে, সেটা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে হচ্ছে, কোনো রাজনৈতিক অপশক্তি সেটা নস্যাৎ করতে পারবে না। সেটা নষ্ট করার অপচেষ্টা কেউ করলে আমরা সেটাকে নস্যাৎ করে দেব। এভাবেই সংগঠনগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব, বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখানে ভীতসন্ত্রস্ত্র হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই বাংলাদেশ আমার, আপনার-সবার। সুতরাং এখানে কেউ ভীতসন্তস্ত্র হয়ে যাতে এমন মানসিকতা ধারণ না করেন যে, এখানে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আমরা কিন্তু প্রতিহত করেছি এবং আগামীতেও করব।’
‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে সাথে নিয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার এবং প্রত্যয় সেটা আমরা অবশ্যই বাস্তবায়ন করব’—বলেন নওফেল।
বৈঠকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শহরাঞ্চলে প্রতিবাদের চেয়ে গ্রামে যেতে হবে। আমাদের চিরায়ত বাংলার যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে, যাত্রাপালা, পুঁথিপাঠ, মুরশিদি গান, জারি-সারি, সেগুলোর পুনর্জাগরণের প্রয়োজন আছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে এক্ষেত্রে ঐক্যমত্যে আসতে হবে।’
সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা নিশ্চয় পরিকল্পিত এবং সরকারকে বেকায়দায় তো ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে সকল পক্ষ থেকে। এখানে একটি রাজনৈতিক শক্তির কথা শুধু আমি বলব না, অনেক জায়গা থেকে করা হচ্ছে। যারা প্রকাশ্য রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা গোপনে এ কাজগুলো করছে। এ ঘটনার আগে ৪৮ ঘণ্টা ধরে একটি রাজনৈতিক দলের সদর দফতরে মিটিং করে কি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং একজন পলাতক দাগী আসামি কি প্রস্তুতির কথা উনাদের বলেছেন, সেটা যদি খতিয়ে দেখা যায়, আমার মনে হয় আমরা আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত পাব।’
পরে তিনি নগরীর রহমতগঞ্জে জে এম সেন হলে যান। সেখানকার পূজামণ্ডপে ১৫ অক্টোবর হামলার ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে তিনি পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম